লেখক- মোঃ নিজাম উদ্দিন
সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতির লীলাভূমি নামে খ্যাত আমাদের এই প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। প্রকৃতি যেন তার অকৃপণহাতে সৌন্দর্য্য দান করেছে তার স্নেহসিক্ত রূপের কন্যাকে। সর্বত্রই আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। যেদিকে দুচোখ যায় সবই যেন একই রকম মনে হয়। যেন সবুজে সবুজে একাকার। এ যেন অপরূপ রূপে সুশোভিত প্রকৃতির সবুজ ভান্ডার। প্রকৃতির রূপের রাণী বললেও অত্যুক্তি হবেনা। চিরায়ত বাংলার এ রূপে আকৃষ্ট হয়ে এর গুণকীর্তন করেছেন নানাজন নানাভাবে। কেউবা বাংলার রূপে বিমোহিত হয়েছেন, আবার কেউবা হয়েছেন পাগল পারা। বাংলার এ রূপ কবি সাহিত্যিকরা বর্ণনা করেছেন নানাভাবে। সাহিত্যিকদের বর্ণনার চেয়ে এ যেন আরও বেশী সুন্দর। সারা জীবন লিখেও যেন এর রূপের বর্ণনা শেষ করা যাবেনা। যুগে যুগে বর্গীরা পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়েছেন বাংলার প্রতি। বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে এসেছেন নানা সময় নানা ভাবে। বর্গীরা বাংলার সম্পদ লুন্ঠন করে নিলেও বাংলার প্রকৃতির রূপ লাবন্য বিনষ্ট করতে পারেনি তিল পরিমাণও।
বাংলা তার চিরায়ত সৌন্দর্য্য বুকে ধারণ করে প্রকৃতির গর্বিত রূপ কন্যার মত মাথা উঁচু করে ঠায় দাড়িয়ে আছে।
ছয় ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতিও যেন তার রূপ বদলায়। ভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতি ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়।
গ্রীষ্মে প্রচন্ড দাবদাহে চৌচির প্রকৃতির রুদ্র মূর্তি। চাতকেরা বৃষ্টির অপেক্ষায় দিন গোনে। অবশেষে আচমকা কাল বৈশাখীর ঝড়ে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়।
আম-জাম, কাঁঠাল সহ রকমারী ফলের পসরা শেষে মধু মাস জৈষ্ঠ্যের বিদায়ের মাধ্যমে প্রকৃতিতে আগমন ঘটে, ভাব- আবেগ প্রবণ ঋতু বর্ষার। বর্ষার আকাশ ভরা সারিসারি শুভ্র মেঘের ভেলা। সারা দিন ঝরঝর ঝমঝম শব্দে বৃষ্টির একটানা দাপট। ভরা নদীতে নব যৌবনা জোয়ারের জল। সারিসারি পালতোলা নৌকা আর নতুন মাছের আনাগোনা। বৃষ্টির সাথে কদম ফুলের মাথা নোয়াবার দৃশ্য দেখে কবিমন আন্দোলিত হয়। নতুন কবিতার সৃষ্টি হয় কবি চিত্তে।
শরতের রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের নির্মল আলো। শিষ দিয়ে যায় ভোরের দোয়েল। গাছে গাছে পাখ-পাখালীর কিচির মিচির শব্দ। সাদা সাদা কাশ ফুলের নরম ছোঁয়ায় মন উদাসী হয়ে উঠে।
নতুন ফসলের ডালা নিয়ে হেমন্ত আসে। নবান্নের উৎসবে মুখরিত হয় বাংলার প্রতিটি ঘর।
কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে প্রকৃতিতে শীত আসে। প্রকৃতির রূপ, রং আর আব্রু হরণ করে শীত প্রকৃতিকে শুষ্ক আর রূক্ষ করে দেয়। গাছে গাছে চলে পাতা ঝরার খেলা । মিষ্টি খেজুর রসের তৈরি পিঠা পায়েসের ধুম পড়ে যায়, বাংলার ঘরে ঘরে।
পূর্ণ যৌবন আর নতুন রূপে নব সাজে প্রকৃতিতে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। চারদিকে রকমারী ফুলের সুগন্ধ আর কোকিলের মিষ্টি মধুর গানে মুখরিত থাকে বাংলার আকাশ বাতাস। দখিনাসমীরণে হৃদয়ে – মনে দোলা দিয়ে যায়। প্রেমিক হৃদয় হয় উদ্ভেলিত।
এ যেন আবহমান বাংলার চিরচেনা রূপ।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ছয় ঋতুর প্রভাব এখন আর সেভাবে প্রতিফলিত না হলেও বাংলার প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র আজও আমাদের হৃদয় হরণ করে। আজও আমরা এর রূপে অভিভূত হই। এখনও এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে গেলে আপনা আপনি মন উদাসী হয়, আমরা আবেগাপ্লুত হই, মনের গহীনে দোলা লেগে যায়। মনে হয় সত্যিই অপরূপা চির সবুজ আমার এই বাংলাদেশ। শ্যামল প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য্যে মন হারিয়ে যায়, অচিন পুরের অজানা ঠিকানায়।
“কি সুন্দর এ দেশ! সেলুকাস”, নেপোলিয়নের এই কথার মর্মবানী উপলব্দি করতে পারি কিছুদিন পূর্বে। ঘুরতে গিয়েছিলাম রাজধানী ঢাকার পশ্চিম পার্শ্বে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদীর চরে।গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়, তুরাগের বুক জুড়ে প্রকৃতি যেন সবুজের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আর প্রকৃতি প্রেমীদের আহবান জানিয়ে বলছে, দেখে যাও আমার রূপ বৈচিত্রের মাধুর্য্য কত সুন্দর। হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে। সবাই মন্ত্র-মুগ্ধের ন্যায় প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে বিমোহিত। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজের সমারোহে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, মন হারিয়েযায় সুদূরের কল্পনায়। সারি সারি ধানক্ষেত, সবুজ ধানে বাতাস দোলা দিয়ে যায়। যেন ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায় দামাল ছেলের মত আর আমায় ডাক দিয়ে বলে যায়, প্রকৃতির রূপে হারিয়ে যাও কোন দূর অজানায়। মাঝে মাঝে আবাদী সবুজ ঘাসের ক্ষেত। লম্বা লম্বা ঘাস তরতর করে বেড়ে উঠেছে। বাতাসে ঘাসের মাথা নোয়াবার দৃশ্যও কম মনোরম নয়। ঘাস ফড়িংদের উড়াউড়ি, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ্ । আমি বিমুগ্ধ নয়নে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করছি।
হঠাৎ মন চঞ্চল হয়ে উঠে। প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াতে মন চায়। দৌড়াদোড়ি শুরু করলাম। আবেগ সামলাতে না পেরে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম। পড়ন্ত বিকেলে প্রকৃতির আহবানে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।
দিবাকর সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ক্লান্তির চাপ গায়ে জড়িয়ে পশ্চিম আকাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পূরো আকাশে সোনালী আভা ছড়িয়ে নিজের অস্তিত্বের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। সে আভা নদীর জলে পড়ে অতী মনোরম দৃশ্যের অবতারণা করছে। হঠাৎ স্পীড বোটের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। পানিতে তরঙ্গঁ সৃষ্টি হলো। নদীর পাড় উপচে সে পানি উপরে উঠে এলো। প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম সে দৃশ্য।
সূর্যাস্ত দেখার জন্য উঁচু বালির ডিবির উপর উঠে পড়লাম। দেখলাম ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশ লাল আভায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে। কপালে লালটিপ পরে নব বধুর সাজে সজ্জিত নীল আকাশ। দিগন্তের শেষ সীমানায় সূর্য যেন ধীরে ধীরে সবুজ বনানীর মাথার উপর নেমে এসেছে। সূর্য আর সবুজ বৃক্ষ যেন আলিঙ্গনে মেতে আছে। দেখতে দেখতে সূর্য বিদায় নিল। কিন্তু ঝিরিঝিরি দখিনা হাওয়ায় শরীর মন জুড়িয়ে যায়। যেন শত জনম এমন সৌন্দর্য্য উপভোগ করার অপেক্ষায় ছিলাম। যেন বহুদিনের কাল্পনিক সে জগতটা আজ বাস্তবে ধরা দিয়েছে। এত ভাল লাগার অনুভূতি জীবনে কখনো ভুলতে পারবোনা। অন্য মনস্ক ছিলাম কতক্ষণ বলতে পারবো না।
হঠাৎ সঙ্গীঁরা বলে উঠলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে চলে যাবো, কিন্তু আমার কিছুতেই আসতে মন চাইলো না। কারণ সন্ধ্যার পর নদীর বুকে রূপালী চাঁদের আলোর খেলা, এ এক অপরূপ দৃশ্য। সারিসারি জোনাকির মিছিল অপূর্ব লাগছে। মনে হয় জনম জনম ধরে এ দৃশ্য উপভোগ করি। হারিয়ে যাই কল্পলোকের গল্প গাঁথায়। দূরে বহুদূরে কোন বিরোহী বাউল করুণ সুরে ভাটিয়ালী গান ধরেছে। মন চাইছে তাকে গিয়ে সুধাই, এত অপূর্ব সুন্দর মুর্হূতে কি এমন দুঃখ তোমার মনে?
বাতাসে ভেসে আসছে হাসনা হেনার মন মাতানো ঘ্রাণ। সব মিলিয়ে এক নৈস্বর্গিক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েেেছ। মন চাইছে জীবনান্দের মত বলে উঠি,
“ বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই,
পৃথিবীর রূপ আমি খুঁজিতে যাইনা আর।”
কিংবা,
“ তোমরা যেখানে স্বাদ চলে যাও,
কিন্তু আমি রয়ে যাবো এই বাংলার পরে।”
ক্ষণিকের জন্য কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। মনের গহীন থেকে বলতে ইচ্ছে করছে,
তোমাদের মন যেথা চায় চলে যাও,
কিন্তু আমি রয়ে যাব এইতুরাগ তীরে।
দেখিবো দখিনা সমীরণে ঘাসেদের দোলা,
দেখিবো নদীর বুকে রূপালী চাঁদের খেলা।
কিংবা
জোনাকিদের অপরূপ মিলন মেলা।
শুনিবো নদীর কুলুকুলু তান,
মিষ্টি সুরের ভাটিয়ালী গান ।
কিংবা
পাখিদের কুুহু কলতান।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সময়ের কাছে হার মানতেই হলো। চলে আসতে হলো নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্যরে মোহ ত্যাগ করে।
অস্ফুট সুরে নিজের অজান্তেই বলতে লাগলাম,
এমন ক্ষণে মন যেতে নাহি চায়,
তবু চলে যেতে হয়;
সময়ের কাছে মানুষ যে বড় অসহায়।
বাংলাদেশ চির সবুজের দেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য মন্ডিত ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটি সত্যি খুবই সুন্দর, মনোলোভা এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। নয়নাভিরাম এসব দৃশ্যাবলী প্রকৃতি প্রেমী মানুষদের করে অভিভুত। মন পবনের নৌকায় ভেসে মানুষ হারিয়ে যায় কল্পনার রাজ্যে। এখানে প্রকৃতি অপরুপ সাজে সুসজ্জিত। এখানে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই, নেই পর্যটন কেন্দ্রেরও শেষ। এ লেখায় যে স্থানটির কথা লিখলাম সেটি কোন দর্শনীয় স্থান কিংবা পর্যটন কেন্দ্র কোন কিছুই নয়, এমনকি সুপরিচিত কোন জায়গাও নয়। কিন্তু গ্রীষ্মের মাঝামাঝী সময় ঘুরতে গিয়ে প্রাকৃতিক সুন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে সে স্থানটির রুপের বর্নণা করার প্রয়াস চালিয়েছি মাত্র। লেখাটি পাঠকদের মনে যদি বিন্দু পরিমানও প্রশান্তির ছোঁয়া দিতে পারে তবেই নিজেকে ধন্য মনে করবো, সার্থক হবে ক্ষুদ্র প্রয়াস।