ডেস্ক রিপোর্ট
বেপরোয়া গাড়ি চালনায় কেউ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত বা নিহত হলে চালকের সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ড এবং জরিমানার বিধান রেখে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বিদ্যমান আইনে একই অপরাধে ৩ বছরের কারাদন্ডের বিধান ছিল। আজ (সোমবার) সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অনুমোদন দেয়া হয়।
বৈঠকের পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে জানান, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মাধ্যমে গুরুতর আহত বা প্রাণহানি ঘটালে এখন নতুন আইনে তার জন্য ৫ বছরের কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অতীতে যেটি ৩ বছরের কারাদন্ডের বিধান ছিল।
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের দাবিতে রাজধানী জুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ নতুন আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে উত্থাপন করে।
‘১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ সংশোধন ও পরিমার্জন করে এই আইনটি করা হয়েছে যেখানে ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে পয়েন্ট সিস্টেম চালুর বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে’, বলেন তিনি।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়ে নতুন আইনে বলা হয়েছে, অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বয়স ১৮ এবং পেশাদার চালকদের লাইসেন্স পেতে বয়স ২১ হতে হবে। চালকের অপরাধের জন্য ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকবে। তার যেকোনো অপরাধের দোষসূচক পয়েন্ট কাটা যাবে। পয়েন্ট শেষ হলে তার লাইসেন্স বাতিল হবে। এছাড়া, কোনো ব্যক্তি মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে জনসমক্ষে কোনো গাড়ি চালাতে পারবেন না। গণপরিবহন চালানোর জন্য আলাদা অনুমতি লাগবে।
আলম বলেন, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মধ্যমে মৃত্যু হলে তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় এটা ইচ্ছাকৃত ছিল তবে দন্ডবিধি ৩০২ ধারা অনুযায়ী তার বিচার হবে। এটার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তবে খসড়া আইনে বেপরোয়া গাড়ি চালনার জন্য জরিমানার সীমা উল্লেখ করা হয়নি। এটি বিচারাধীন মামলার বিচারকের ওপর ছাড়া হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘মোটরযান দুর্ঘটনায় আহত বা প্রাণহানি হলে পেনাল কোড অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে শর্ত থাকে যে, পেনাল কোডে যা কিছু থাকুক না কেন অবহেলাজনিত কারণে গুরুতরভাবে আহত বা প্রাণহানি হলে পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।’ সংসদের আগামী অধিবেশনে আইনটি পাসের জন্য তোলা হবে বলেও জানান তিনি।
চূড়ান্ত খসড়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান করা হয়েছে। কেউ এই অপরাধ করলে তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে। বর্তমানে এই অপরাধে তিন মাসের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা রয়েছে। কোনো অপরাধীকে লাইসেন্স দেওয়া হবে না। আর আগে দেওয়া হয়ে থাকলে তা প্রত্যাহার করা হবে।
বাসচালকের সহকারী লাইসেন্স ছাড়া গাড়িতে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ ছাড়া রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালানো যাবে না। মোটরযানের মালিকানা পরিবর্তিত হলে তা ৩০ দিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটলে ডাইভার, হেলপার বা তাদের প্রতিনিধিকে নিকটস্থ পুলিশ থানা, দমকল স্টেশন এবং হাসপাতালকে জানাতে হবে এবং দুর্ঘটনা কবলিতদের দ্রুত চিকিৎসার উদ্যোগ গ্রহণের কথা এই খসড়ায় বলা হয়েছে।
সড়কে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আক্রমণাত্মক আচরণ ও জনরোষ নিয়ন্ত্রণে গাড়ির কোনো ক্ষতি না করার কথা বলা হয়েছে নতুন আইনে। ওই সময় চালক বা সহকারীদের ওপর কোনো আক্রমণাত্মক আচরণ করা যাবে না।
দুর্ঘটনায় জড়িত মোটরযান বা মোটরযানের যাত্রী বা ঘটনাস্থলে সমবেত হয়ে জনশৃঙ্খলাপরিপন্থী কোনো ধরনের আচরণ করতে পারবে না। কোনো সংগঠনের ব্যানারেও এসব আচরণ করা যাবে না। চালকের সিটবেল্ট বাধা বাধ্যতামূলক, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার এবং বিপরীত লেন দিয়ে গাড়ি চলানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই আইনে।
কেউ মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে, মদ্যপ হলে বা অন্যান্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হলে লাইসেন্স স্থগিত থাকবে। সুস্থতার প্রমাণ পেলেই লাইসেন্স আবার কার্যকর হবে। নিবন্ধন ছাড়া গাড়ি চালালে ছয় মাসের কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে ।
ফিটনেস না থাকা মোটরযান চালালে বর্তমানে শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার দ্বিগুণ করে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করার প্রস্তাব করা হয়েছে চূড়ান্ত খসড়ায়। গাড়ির মালিক এ শাস্তি ভোগ করবে।
গাড়ির চেসিস বা আকার আকৃতির পরিবর্তন করলে তিন বছরের কারাদন্ড এবং তিন লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমান আইনে এক্ষেত্রে দুই বছরের কারাদন্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।
চালকের কর্মঘণ্টাও নির্দিষ্ট করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে চূড়ান্ত খসড়ায়। নতুন আইনে রাজধানী বা দেশের কোনো এলাকায় বা সারাদেশে মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে পারবে সরকার। কোন যানবাহন কত বছর চালানো যাবে, তাও নির্ধারণ করে দিতে পারবে সরকার।
মোটরযানের গতিসীমা এবং শব্দমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কথাও বলা আছে। পার্কিং এর স্থান নির্দিষ্ট করে দেয়ার কথাও বলা আছে। চালক কোনোভাবেই সহকারীকে গাড়ি চালাতে দিতে পারবে না, মদ্যপ বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে বা তার উত্তরাধিকারকে আর্থিক সহায়তা দিতে বা চিকিৎসার খরচ যোগাতে তহবিল করার কথাও বলা আছে।
এছাড়া, পুলিশ দেশব্যাপী টোল ফি নম্বর প্রবর্তন করবে (জরুরি নম্বর ৯৯৯ প্রবর্তন করা হয়েছে) যার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত মোটরযানের চালক ও তার সহকারী, মালিক, পরিচালক বা তাদের প্রতিনিধি বা অন্য কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নম্বরে ফোন করে জানাতে পারবে।