কবির যাত্রা- রেজাউদ্দিন স্টালিন

136
34

সাক্ষাৎকার গ্রহণ- মোঃ আলমগীর সিদ্দিকী

কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর যশোর জেলার নলভাঙা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাসাহিত্যের একজন ভিন্নধারার স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত কবি তিনি। মানুষকে আবিষ্কার করেন তাঁর ঐতিহ্যের চোখ দিয়ে আর কাব্যকলার নির্যাসকে উন্মোচন করেন ইতিহাসের ইতিবাচক বাকপ্রতিমায়। তাঁর কবিতায় বারংবার প্রতিভাসিত হয় গণমানুষের আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন, জীবনদর্শন-প্রকৃতি-রাজনীতি-সমাজ-পুরাণ-গা-গঞ্জ-ন্যায়-অন্যায়-প্রেম-বিরহ-আনন্দ। জীবন ও জগতের সবকিছু ছুয়ে-ছেনে দেখেছেন বলেই একজন ভিন্নস্বরের কবি হিসেবে তার আত্মপরিচিতি। কবির নিরবচ্ছিন্ন লেখনী আমাদের জাতিসত্তার জাগরণে সদাজাগরুক। কবিতাই জীবনের অণিষ্ট মিরোম্নাভ হলুভের ভাষায় কবিতা আমাদের শেষ কাজগুলোর নয় বরং প্রথম কাজগুলোর অন্যতম, রেজাউদ্দিন স্টালিন গভীরভাবে তা’ বিশ্বাস করেন। ধারাবাহিক সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন-বাংলা একাডেমী,মাইকেল মধুসূদন,সিটি আনন্দ আলো,ধারা সাহিত্য সাংস্কৃতিক আসর,পদক্ষেপ, অগ্নিবীণা, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, পাণ্ডুলিপি, দার্জিলিং নাট্যচক্র, সব্যসাচী, তরঙ্গ অফ ক্যালিফোর্নিয়া ও আমেরিকার বাদাম পুরষ্কারসহ নানা সম্মাননা ও পুরষ্কার। তাঁর প্রতিবাদী কাব্যভাষা-পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে অব্যর্থ অস্ত্র যা তাকে দিয়েছে অর্জুনসম তীরন্দাজের অভিধা। অক্টাভিও পাজের ভাষায় কবি হবেন একই সাথে-তীর, তীরন্দাজ এবং চাঁদমারী রেজাউদ্দিন স্টালিন এই উক্তির সমার্থক; জনতার লোক হিসেবেই সর্বজনগ্রাহ্য তিনি। এতে কোন সন্দেহ নেই যে দেশের সীমা অতিক্রম করে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৪০, গদ্যগ্রন্থ ৪টি, শিশুতোষগ্রন্থ ২টি, উপন্যাস ১টি, সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ২টি। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-ফিরিনি অবাধ্য আমি, আশ্চর্য আয়নাগুলো, আশীর্বাদ করি আমার দুঃসময়কে, ভাঙা দালানের স্বরলিপি, মুহূর্তের মহাকাব্য,জমজ সহোদর, সব জন্মে শক্র ছিলো যে, বায়োডাটা,জ্যামিতি বাক্রের গল্প। গদ্যগ্রন্থ-আরোগ্য রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের আত্মনৈরাত্ম, নির্বাসিত তারুণ্য, ডাকঘর। উপন্যাস-সম্পর্কেরা ভাঙে। শিশুতোষ গ্রন্থ- হাঁটতে থাকো, চাবুক।

প্রশ্ন: কবি হিসেবে কবে থেকে আপনার যাত্রা শুরু ?

উত্তর : সব কিছুরই একটা যাত্রাকাল বা লগ্ন থাকে। এটা একটা দার্শনিক প্রক্রিয়া। এই শুরুটা মাতৃগর্ভ থেকে কিংবা বোধের প্রায়োগিক সময়পর্ব থেকে। কিন্তু সব সৃষ্টিশীলতার একটা সবুজ সংকেত থাকে তা’ জ্বলে হঠে প্রাণের ইঙ্গিতে। এই যে সংকেতটা জ্বলে উঠলো তা’ কৈশোরকাল থেকেই। তখন ১৯৬৯ সাল। দেশটা ক্রশম; অগ্নিগর্ভ। সামাজিক বিন্যাসগুলো ভেঙে পড়ছে নতুন আকাংঙ্খার প্রবলতায়। সমাজ স্বভাবের সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার অন্তর্বয়ানের অভিব্যক্তি সংযুক্ত হতে থাকে। এক সামষ্টিক পরিকল্পের রূপান্তর হলো স্বাধীনতা’। ঐ কৈশোরেই স্বাধীনতার জন্য যে-বোধন-প্রস্তুতি তার বহি: প্রকাশ ঘটেছিলো প্রত্যাশায় প্রতীজ্ঞায়। প্রথম লেখা ‘শপথ’। চার লাইন। “পুষ্প-যেমন মানব সেবায়/জীবন করে দান/আমরা তেমন দেশের সেবায়/বিলিয়ে দেব প্রাণ।” প্রকাশ পেলো যশোরের শতদল’ কাগজে। সাহিত্যের এই পদ্যফর্মে বাল্যের আবেগ সত্যায়িত হয়েছিলো। আর সেদিন থেকেই হৃদয়ের রূপান্তর ঘটতে থাকলো ক্ষোভ ও আকাংখা প্রকাশের। ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছাসে সে কোলাহলের রুদ্ধ স্বরের আমি পাই উদ্দেশ/জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে। সুকান্তের মতো এই অনিবার্য ভাঙনের সহযাত্রী হলাম। যদি বলেন লেখা লেখির জগতে প্রতিষ্ঠা পেলেন কিভাবে ? এই একটা জগৎ যেখানে প্রতিষ্ঠা হয় না, স্থান হয়। একটু বসার জায়গা বা দাঁড়াবার জায়গা হয়। একশো বছর পর যদি কারো নাম সমাজে সঞ্চারিত হয়, সেখানেই সার্থকতা যেমন উচ্চারিত হয়েছিল- “যা নিষাদ তমগম শ^াশতী সমা/যৎক্রৌষ্ণ মিথুন দে/কাম বোধি কাম মোহিতাম”। নিষাদ মিথুন মগ্ন ক্রৌঞ্চকে হত্যার দায়ে অভিশপ্ত হলেন। শ্লোক শুনলেন-সেখানে পরিতাপের কথা আছে। হত্যার অপরাধে নিষাদ কখনো সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবে না-এ আশ্চর্য অভিশাপ। এই অভিশপ্ত শ্লোক নিয়েই সব কবির যাত্রা।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে কবিতার ভবিষ্যৎ কি ?

উত্তর : পৃথিবীর সবদেশে সব কালে কবিতার ভবিষ্যৎ দূরতা ঘেরা আলোকসূত্রের মতো। একজন পথিক বহুদূরে লোকালয়ের আলো দেখে কিংবা একজন আকাশ চিন্তক রাতের নক্ষত্র দেখে-যেভাবে গন্তব্য গড়ে তোলে সেভাবে সমাজের চলচ্চিত্র ও প্রচার প্রসার দেখে অনুমিত হয়-কবিতার ভবিষ্যৎ সেই দূরতম আলোর আভাস। আলোর ভবিষ্যৎ যা’ কবিতারও তাই। পাথিক যত নিকটবর্তী হবে তত আলো পাবে পাঠক যত গ্রন্থের নিকটবর্তী হবে আলো পাবে। কবিতা হলো নক্ষত্রের মতো বহু শতাব্দী-বছর ধরে মানুষের অন্তরের দিকে, বোধের দিকে আসতে থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই আলো পায়। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এই চরণের আলো পাচ্ছি শতাব্দীকাল।

‘যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী’
যে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’

কবিতার এই লাইন দুটি চরণ এখনো উচ্চারিত হচ্ছে অস্তিত্বের সনাতন কেন্দ্রে পূর্বতন প্রচল ভেঙে যায়। কিন্তু কাব্যসত্যের পরিকল্প স্থিত থাকে, সভ্যতার প্রথম পর্বে মানুষকে মহাকাব্যের কাহিনীগুলো গেয়ে শোনানো হতো। আবৃত্তি ও ছিলো যাত্রাশিল্পের প্রতিস্বর টানা সুর করে পাঠ এবং প্রলম্বিত লয়। সে এখন অনেকটা নির্ভার, একা। চর্তুদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী-সঙ্গীত-চিত্রকলা, উপন্যাস চলচ্চিত্র ক্রীড়া। কিন্তু কবিতা সাহসী সংশপ্তক। তার যাত্রা একাকী গভীর অরণ্য থেকে লোকালয় পর্যন্ত। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে। একলা চলার অধ্যাবসায় ও অনুশাসন মান্য করেই এগুতে হবে এখানেই কবিতার ভবিষ্যৎ।

প্রশ্ন : কবিদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা কতটা বাঞ্চনীয় ?

উত্তর : রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। নোবেল জয়ী পোল্যান্ডের কবি ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কার একটা কবিতার উদ্ধৃতি দিতে চাই ‘আমরা আমাদের যুগের সন্তান/যুগটা রাজনৈতিক। সারাটা দিন, সমস্ত প্রহর ধরে, তোমার-আমার, তাদের সব ঘটনাই-রাজনৈতিক ঘটনা।’ এই কবিতা থেকেই আমরা একটা আন্দাজ পেয়ে যাই। বিশে^র প্রতিটি শিল্পকলা ও সংস্কৃতি রাজনৈতিক চিন্তায় পরিপ্লুত। আমরা জানি মানুষের সবরকম এমনকি প্রেম মাধুর্যের সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেয় শ্রেণী। অর্থাৎ রিলেশন যা’ এক সময় রূপ নেয় ডোমিনেশনে যাকে আমরা প্রভুত্ব বলি। আনুগত্য নির্ভর এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিল্পীকেও তার স্বাতন্দ্রবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। রেঁনেসাসের যে মূলমন্ত্র তা আর থাকে না বরং ভাষা এবং কলার মধ্যে তৈরূ হয় ব্যবধান। নীতি, বিবেক, মূল্যবোধ, আবেগ শোচনীয়ভাবে বেগের তোড়ে ভেসে যায়। কিন্তু প্রকৃত যে কবি, যে শিল্পী সে বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে থাকে। টমাস কুন তার The Structure of Scientific Revolution (১৯৬২) বইয়ে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বোধের কথা বলেছেন-সেই বোধ তৈরী করে সৎ শিল্পীরা। তারা ইতিহাস ঐতিহ্য প্রকৃতি বিজ্ঞান, এবং নৃবিজ্ঞানের শরণ নেয়। জেমস ফ্রেজার এই ধারাক্রমকে লোকায়াত বিশ্বাসের ছাঁচে ফেলে ব্যাখ্যা করেছেন যার মধ্যে শ্রেণি দ্বন্দ্বের ইতিহাস এবং সমাজের সাবমিশন পরিদৃষ্ট। ৬৯ গণ আন্দোলন, ৫২ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচার বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে কবিদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নতুনভাবে আমাদের আশান্বিত করে। প্রযুক্তি সমৃদ্ধ পৃথিবীতে এখন বৈশ্বিক রাজনীতিও সাহিত্যে কবিতায় উৎকলিত। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা কোনো কবি নতুন প্যারাডাইম তৈরী করতে পারে না এবং তার লেখা সচেতন পাঠকের কাছে সমাদৃত হয় না।

প্রশ্ন : ডিজিটাল বাংলাদেশে কবিতার পাঠক ও কবিতার সম্পর্কে কি বলবেন?

উত্তর : প্রযুক্তির উন্নয়ন একই সাথে মুক্তবাজার অর্থনীতি দুইয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্ম্পক আছে। উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ নিজস্ব পুঁজিতৈরীর জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে কিন্তু প্রতিপদে তাকে উন্নত সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এদেশকে একটা অর্থনৈতিক উপনিবেশ তৈরী করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারত সমভাবে সচেষ্ট ও তৎপর। তাদের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বর্জন, আমদানী ও রপ্তানীর বিষয়গুলি নির্ধারিত হয়। তা’ না হলে ক্ষমতা বদল, শাস্তি ও দণ্ড- এমনকি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আশংকা থাকে বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এনজিও সংস্থা নানাভাবে কাজ করে। এই আধিপত্যবাদী ও উপনিবেশ বিরোধী চিন্তার কবিরা নানাভাবে উচ্চারিত হবে এবং সময় তাদের দাবি করবে। যদিও ফেসবুক, ওয়াল, ইউটিউব, টুইটার ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি প্রযুক্তি পাঠককে প্রলোভিত করছে অন্যদিকে গভীর চিন্তার বদলে স্থ’ল চিন্তায় ডুবে আনন্দ পাচ্ছে পাঠক। অনেক কবিতা পোস্ট করা হচ্ছে এবং অপাঠকরা প্রশংসা করেছে এটা প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং এক ধরণের মনোবিকলন। কিন্তু সৎ ও চিন্তাশীর পাঠক পড়বে তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে। আত্মআবিস্কারের ক্ষেত্রে সে বরাবরের মতো নির্ভীক হবে এবং প্রতিক্রিয়া ও মতামত দেবে। কবিতার ভবিষ্যৎ সব সময়ই সংগ্রামমুখর। সত্য কখনো সমাদৃত নয় নিপীড়ক শ্রেণীর কাছে। বরং সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের কাছে কবিতার আবেদন থাকবে এবং বাড়বে।

প্রশ্ন : চলচ্চিত্রে জীবনমুখীতা নেই। এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলবেন ?

উত্তর : চলচ্চিত্র আমার একটা প্রিয় বিষয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে অর্থাৎ সত্তুর দশক পর্যন্ত বাংলা সিনেমা দেখা যেতো। পরিবারের সকলে মিলে সিনেমা দেখা একটা চমৎকার বিনোদনের বিষয় ছিলো। মনে আছে অনেকগুলো ছবির কথা। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নীল আকাশের নিচে, যে আগুনে পুড়ি, অবুঝ মন, অরুণোদয়ের অগ্নি সাক্ষী, এপার ওপর, ওরা এগারোজন, আলোর মিছিল এই ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে। পাশাপাশি ব্যাতিক্রমী ছবি সূর্যদিঘল বাড়ি, সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা, সারেং বউ ছবিগুলো সামাজিক জীবনে প্রভাব তৈরী করেছিলো। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছিলো সমাজ সচেতন ছবি। আমজাদ হোসেন এখন আমাদের মধ্যে নেই তার কথা মনে পড়ে। এই ছবিতে গল্প বলার পাশাপাশি কিছু নতুন ইমেজ তৈরীর প্রচেষ্টা ছিলো। এখন যে সমস্ত ছবি তৈরী হয়েছে বা হচ্ছে তাতে প্রকৃত সমাজ চিত্রের প্রতিফলন ঘটে না। কাব্যময় যাকে আমরা শিল্প বলি তার বালাই নেই বরং এক ধর্ষণ সিরিজের ওঠানামার অশ্লীল পাঠক্রম। মাস্তানী, খুন, ধর্ষন, অশ্লীল নাচ, প্রেমের নামে অশুদ্ধ উচ্চারণ, ব্যক্তিত্বহীনতা এবং কাহিনীর স্থুলতা ও দূর্বলতা বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রকে বিনষ্ট করেছে।’ ভালো জীবনঘনিষ্ঠ ছবির জন্য প্রয়োজন সাধু উদ্যোগ কবিতার কোনো শিল্পাধার যেন থাকে এমন চলচ্চিত্র আমরা চাইবো।

প্রশ্ন : ক্রিকেট এখন অনেক উত্তেজনা তৈরী করছে। ফুটবল প্রায় নির্বাসিত। যতদূর জানি ফুটবল আমাদের প্রিয় আপনি নিজেও খেলতেন। আমাদের ক্রীড়াক্ষেত্র ও কাব্যক্ষেত্রের অবস্থা কি ?

উত্তর : হ্যাঁ কর্পোরেট কালচার এমন এক খেলার প্রবর্তন করেছে যা’ গণমানুষের খেলা নয়। উপনিবেশিক শক্তি শোষক শ্রেণীর সময় যাপনের এবং অর্থ উপার্যনের এক প্রক্রিয়া। আজ যারা পৃথিবীতে ক্রিকেটে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করছে তারা মানুষের অধিকার আন্দোলন থেকে তরুণ সমাজকে বিচ্ছিন্ন করতে তৎপর। জানি এক সময় জার্মানিতে খেলাটি নিষিদ্ধ ছিলো। সর্বোপরি খেলাটি ব্যয় বহুল। এই খেলাকে কেন্দ্র করে কত সংস্থার জন্ম হয়েছে। আমরা বাঙালিদের জনপ্রিয় খেলাগুলোকে নির্বাসনে দিয়ে এখন বেঁচে আছি অন্য সংস্কৃতিতে। মধুসূদনের উপলব্ধি-‘পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি’। আজ আমাদের ক্রীড়া জগতকে আবার মূল ধারার ঐতিত্যে প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং ফুটবল খেলা ও কবিতা লেখা দুটোই হবে জীবনের পরিপূরক। আমি কৈশোরে স্কুল জীবনে ফুটবল খেলতাম। এখন জাতি গঠনে ক্রীড়া ক্ষেত্রকে আরো ঢেলে সাজাতে হবে। তৃণমূল থেকে খেলোয়াড়দের সুযোগ তৈরী করে দিতে হবে। শুধু রাজধানী নির্ভর ক্রীড়া ও সংস্কৃতি আমাদের সম্ভাবনাকে ছোটো করে ফেলবে। ইদানিং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাই বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিভাবান তরুণদের দেখে আশান্বিত হই। গানের ক্ষেত্র ভালো আর প্রকৃত প্রস্তাবে কবিতার অবস্থা খুবই নাজুক। এখনো অনেকে ২০ কিংবা ৩০ এর দশকের ভাষায় কবিতা লেখেন। কোনো পাঠ নেই। অনেকে মনে করেন কবিদের কোনো পড়ালেখা প্রয়োজন নেই। কল্পনার শক্তি থাকলেই চলবে কিন্তু কল্পকরও শিক্ষা প্রয়োজন। হাজার হাজার কবি কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য লাইন তৈরী হচ্ছে না। কি ভয়ংকর কথা। এটা কেন হবে যদি উন্নয়ন হয় তবে সব শিল্পের ও প্রযুক্তির এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রের সমান্তরাল উন্নয়ন ঘটবে। একটি ক্ষেত্র অনেক উন্নত অন্যক্ষেত্র শূন্য এটা একটা অসম ব্যবস্থা। এটাকে সংস্কার করতে হবে। সাংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অসমতা থেকে যাবে যা’ অদৃশ্য কিন্তু দূরগামী আর অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তা’ পরিদৃশ্যমান।

প্রশ্ন : প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার কবিতার বই প্রকাশ পায় কোনো গ্রন্থ একশোর বেশী বিক্রি হয় না -কেন?

উত্তর : কবিতার বইয়ের বিক্রি সব সময় কম। আসলে জ্ঞানদীপ্ত গভীর শিল্প সম্মত ও চিন্তা উদ্রেককারী বইয়ের বিক্রি কম। সাধারণ মানুষ চায় সস্তা বিনোদন। সস্তা বিনোদনের স্থলে ফেসবুক, টুইটার, টিউব, ওয়াল, ম্যাসেঞ্জার ভাইবার কত যে সময় ক্ষেপনের মাধ্যম। বিনা কষ্টে ‘সবই হাতের কাছে এমন কি যে কোনো তথ্য। ভালো বইয়ের বিক্রি কম কিন্তু এই বিক্রি দীর্ঘস্থায়ী। সের্গেই লুইস বোর্হেস বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ লাতিন চিন্তক। তার প্রথম বই বিক্রি হয়েছিলো ৭ কপি। তবে একথা সত্য অধিকাংশ কবিদের পড়াশুনা কম। তারা বই কেনে না। মনের আবেগে কবিতা লেখে। সাহিত্য পাতাগুলোও পড়ে না, দেখেও দ্যাখে না। তবে বেশ কিছু শক্তিমান কবি হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে তাদেরকে শনাক্ত করতে হবে। আমি মনে করি কবিতার ইতিহাস হচ্ছে বিষয় এবং টেকনিকের ইতহাস। ছন্দ, উপমা, রূপক উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প এগুলো বাড়তি সৌন্দর্য। কবিদের নিজেদের অস্তিত্ব নির্মাণার্থে প্রত্যেকের ভালো কবিতার বই কেনা ও পড়া উচিত।

প্রশ্ন : বাংলা কবিতার অবস্থান কি উন্নত বিশ্বের কবিতার পাশে দাঁড়াতে পারছে ?

উত্তর : সমাজ সংস্কৃতির বিশ্বরূপ আবিস্কারে অলংকার শাস্ত্র, গনিত, জ্যামিতি, জীববিদ্যা, ইতিহাস এবং বিজ্ঞান গভীরভাবে কাজ করে থাকে। একটা উপনিবেশিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষত বিক্ষত নির্যাতিত এবং রক্তাক্ত। একজন কবির মধ্যে এই সংবেদন প্রতিবাদে রূপান্তরিত হয়। উন্নত বিশে^র সংকট এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থার মধ্যে অনেক মিল আছে। পুঁজি নির্ভর সমাজে ব্যক্তির মূল্যায়ন হয় অর্থ দিয়ে। জ্ঞান সেখানে হাসফাঁস করে। কবিতার কণ্ঠনালী চেপে ধরা হয়। মূলত এই অভিজ্ঞতা বৈশ্বিক বেদনার সাথে সংগতিপূর্ণ। এই ধারায় যে প্যারাডাইম তৈরী হয় তা বিশ^মানের। আমরা তাকাই পৃথিবীর বড় কবিদের দিকে তাদের চিন্তার দিগন্ত আবিস্কার করি সেখানে বাংলা কবিতার শক্তিমানদের ও দেখতে পাই, তাদের শক্তির স্ফুরণ অনুভব করি। মাইকেল, রবীন্দ্র, নজরুল সুকান্ত, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সমর সেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুনীল, শক্তি, আবুল হাসান, রফিক আজাদ এদের কবিতা বিশ্বমানের।

প্রশ্ন : বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কি ?

উত্তর : আগে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক এবং প্রতীকী দৃষ্টিকোন থেকে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ ভালো, এর রূপান্তর ঘটছে। বহুমুখীনতা বাংলা কবিতার একটা বড় গুন। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যাপকতা বাংলা কবিতাকে দাঁড় করিয়েছে বিশ্ব পাঠকের মুখোমুখি। কি অনুবাদে কি-অনুভবে। এক রক্তাক্ত উপত্যকা পার হয়ে আরেক মৃত্যু উপত্যকায় আমরা দাঁড়িয়ে। এই জন্মভূমির ভষ্মস্তূপ থেকে ফিনিস্ক পাখির মতো বাংলা কবিতা বার বার বেরিয়ে আসে এবং নতুন জগত নির্মাণে ব্রতী হয়, এখানেই তার ভবিষ্যৎ।