এমএসএ
মারভেল কমিকসের অন্যতম কল্পিত সুপারহিরো ব্লাক প্যান্থার। ১৯৬৬ সালের ফ্যান্টাস্টিক ফোরের একটি সংখ্যা দিয়ে চরিত্রটির যাত্রা শুরু হয়। মূলধারার অ্যামেরিকান কমিকসে এই প্রথম কোন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সুপারহিরোকে তৈরি করেন কমিক বই লেখক স্ট্যান লী ও লেখক-আর্টিস্ট জ্যাক কার্বি। কমিক জগতে তখনো কোন কৃষ্ণবর্ণা সুপারহিরো বা প্রধান চরিত্রের আবির্ভাব হয়নি। ব্লাক প্যান্থারের পর মারভেল জগতে এসেছে অন্যান্য আফ্রিকান আমেরিকান সুপারহিরো- ফ্যাল্কন (১৯৬৯), লিউক কেজ (১৯৭২), ব্লেড (১৯৭৩), ডিসি কমিকসের গ্রীন ল্যান্টার্ন জন স্টুয়ার্ট (১৯৭১)।
২০১৮ সালে ব্লাক প্যান্থার কমিকসের অবলম্বনে মুক্তি পেয়েছে মারভেল স্টুডিওর “ব্লাক প্যান্থার” চলচ্চিত্র, যদিও চরিত্রটির চলচ্চিত্রে প্রথম পদার্পণ ঘটে ২০১৬ সালের ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার’ ছবির মধ্য দিয়ে। “ব্লাক প্যান্থার” ছবির পরিচালক রায়ান কূগলার এক সাক্ষাৎকারে চরিত্রটি সম্পর্কে বলেছিলেন, “আপনি যদি ব্লাক প্যান্থারকে প্রশ্ন করেন যে সে কোন সুপারহিরো কিনা, তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাবেন। তিনি নিজেকে রাজনীতিজ্ঞ ও নিজ দেশের একজন নেতা হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। ওয়াকান্ডা দেশটির প্রায় সকলেই যোদ্ধা। এখানে নেতাকে যোদ্ধা হতে হয়, সেই সাথে কখনও কখনও তাকে যুদ্ধেও যেতে হয়।” সিনেমাটি কল্পিত কাহিনীর উপর তৈরি হলেও এর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু অনেকটা ভাবিয়ে তোলে।
ছবির প্লট থেকে জানা যায়, শতাব্দী আগে আফ্রিকায় ভাইব্রেনিয়ামসহ একটি উল্কাপিণ্ড পতিত হলে পাঁচ আফ্রিকান জাতি (ট্রাইব) তার দখল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। এসময় প্যান্থার গড বাস্ট সেখানে অবতীর্ণ হন। প্যান্থার ট্রাইবের সুহৃদয়ের এক যোদ্ধাকে (বাশিংগা) সে ‘হার্ট শেপড হার্ব’ (এক প্রকারের ঔষধি) এর কাছে নিয়ে যায়। হার্ব সেবনের পর বাশিংগা সুপারহিউম্যান ক্ষমতা লাভ করে এবং হয়ে উঠে জাতির প্রথম ব্ল্যাক প্যান্থার।
হার্ট আকৃতির ঔষধি পান করার পর প্যান্থার হয়ে উঠে মহাশক্তির অধিকারী। প্যান্থার গড বাস্টের সাথে তার সংযোগ তৈরি হয়। বাস্টই তার সকল শক্তির উৎস। তার ইন্দ্রিয়গুলো তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়ে উঠে, বেড়ে যায় রিফ্লেক্স। শক্তি, দ্রুতমননশীলতা, গতি, সহনশক্তি, আরোগ্য ক্ষমতা হয়ে উঠে অসামান্য। ব্লাক প্যান্থারের রয়েছে অসংখ্য শিকারের ঘ্রাণ মনে রাখার ক্ষমতা। আনডেড, অর্থাৎ, অশরীরী আত্মাদের নিয়ন্ত্রণ করতেও সে সক্ষম। বংশ পরম্পরায় প্যান্থার ট্রাইবের টি’চাকার মৃত্যুর পর ব্লাক প্যান্থার ও রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে প্রিন্স টি’চালা। কমিকস বা তার এডাপ্টেশনগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টি’চালাকে ব্লাক প্যান্থার হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে।
ব্লাক প্যান্থার টি’চালা একজন দক্ষ শিকারী, ট্রাকার, স্ট্রাটেজিস্ট, রাজনীতিজ্ঞ, উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী। অক্সফোর্ড থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে সে তার পিএচডি অর্জন করেছে। ভাইব্রেনিয়ামে সমৃদ্ধ দেশ ওয়াকান্ডাকে টেকনোলজিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অপেক্ষা অধিকতর উন্নত করতে তার অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। আক্রোব্যাটিক্স ও হ্যান্ড টু হ্যান্ড যুদ্ধেও সে প্রশিক্ষিত। প্যান্থার গোষ্ঠীর এই সেনানায়ক পৃথিবীর ধনীদের মধ্যেও অন্যতম।
ব্লাক প্যান্থারের অস্ত্র সরঞ্জামাদি হিসেবে রয়েছে এনার্জি ড্যাগার, ভাইব্রেনিয়াম স্যুট ও একটি পোর্টেবল কম্পিউটার ‘কিময়ও কার্ড’। ব্লাক প্যান্থার ভলিউম ফোর কমিকসে তাকে ‘থ্রাইস ব্লেড আরমর’ ও ‘লাইট আরমর’ ব্যবহার করতে দেখা যায়।
পর্যায়ক্রমে ব্লাক প্যান্থার ম্যান্টেল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অতিবাহিত হয়েছে। একারণে অনেককেই ব্লাক প্যান্থার হতে দেখা যায়। বাশিংগা থেকে শুরু করে টি’চাকার বাবা চানদা, টি’চাকা, এরিক কিলমংগার/এন’জাদাকা, এস’ইয়ান (টি’চাকার ভ্রাতা), ও শুরি ব্লাক প্যান্থার হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। পেছনের কাহিনী হিসেবে কমিক্সের কিছুটা রেফারেন্স দিলে হয়তো কাল্পনিক জগতটি কিছুটা বাস্তবিক মনে হতে পারে। কারণ অনেক বাস্তববাদীদের কাছে ওয়াকান্ডা বা ব্লাক প্যান্থার এক অলীক বিষয়বস্তু ছাড়া তেমন কিছুই না। এবং এটাই সত্য।
২০১৮ সালে “ব্লাক প্যান্থার” ছবিটি বক্সঅফিস কাপিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছবিটির আয় ১.৩৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। কুড়িয়েছে প্রশংসা ও সমালোচনা। তবে ছবিটিকে আফ্রিকান প্রোপাগান্ডা না বলে তাদের দীর্ঘশ্বাস অথবা সম্ভব্য ভবিষ্যৎ বলা যেতে পারে। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের শিকারে আফ্রিকা যেভাবে নিষ্পেষিত হয়েছিল, যেভাবে ক্রীতদাস-দাসীদের সেখান থেকে নিয়ে অত্যাচার এবং হত্যা করা হয়েছে তা কোনভাবে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আর্থ-সামাজিক-মানসিক অত্যাচারের ইতিহাস ও বর্ণবাদের নির্মম পরিহাসের প্রতি এক উজ্জ্বল পরবাদ “ব্লাক প্যান্থার”।
ব্লাক প্যান্থারের সৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে ঠিকই, তবে তার আবাসস্থল আফ্রিকায়। অর্থাৎ কল্পিত ওয়াকান্ডা দেশটির অবস্থান দেখানো হয়েছে দক্ষিণ সাহারার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। এই মর্ম উপলব্ধি করেই হয়তো কিলমংগারের চরিত্রটিও বাস্তবতার নিরিখে ফুটে ওঠে। যেখানে টি’চালা জন্মগতভাবে একজন আফ্রিকান, সেখানে কিলমংগার একজন আফ্রো আমেরিকান। তার শরীরে রয়েল ব্লাড ঠিকই আছে কিন্তু ওয়াকান্ডায় তার স্বীকৃতি নিশ্চল, যদিও টি’চালাকে হটিয়ে সে জোরপূর্বক ম্যান্টেলটি অধিকার করে। তবে তার শেষ রক্ষা আর হয়নি। যে ওয়াকান্ডাকে ছেড়ে তার পিতা ট্রাম্পের দেশে এসেছিল, তার পুত্রকে বরণ করেনি ওয়াকান্ডার মাটি। সকল আফ্রো আমেরিকানদেরই হয়তো একটা সুপ্ত ইচ্ছা থাকে তাদের রুট/শেকড় আফ্রিকায় ফিরে যাওয়ার, তবে সেটা কোন কারণে সম্ভব হয়ে উঠে কি?
কৃষ্ণাঙ্গ বিষয়টি যে শুধুই একটি চিন্তা তার প্রমাণ মিলেছে কূগলারের রিপ্রেজেনটেশনে। বলছিনা রায়ান কালো এজন্য সে কালোদের স্বকীয় সংস্কৃতি, তাদের ঢোলের ঢাক, নাচ, পোশাক যা তাদের তা সঠিক ভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। কালো বলাটাও আফ্রিকানদের কাছে গালির সমেত। একথা কোন ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না, আজ যদি আফ্রিকা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা বর্ণবাদের শিকার না হতো, তাহলে ওয়াকান্ডার মত এক ইউটৌপিয়ান জগতের বাস্তবিক রূপ আমরা আফ্রিকায় ঠিকই দেখতে পেতাম। আর এমনটাই ফুটে উঠেছে রায়ানের চিত্রায়ণে। ইংরেজরা ঠিকই সক্ষম হয়েছিল আফ্রিকান সংস্কৃতি ভেঙে তাদের সম্পদ লুঠ করতে, তবে ছবিতে ইউলিসিস ক্ল ব্যর্থ হয়েছে। ছবিতে ইউএনের সম্মেলনে চ্যাডউইক বোসম্যানের শেষ হাসিটি অভিশপ্ত অতীতের সকল দুঃখ কষ্টকে পেছনে ফেলে দেয়। ব্লাক প্যান্থার যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল দেশের সাথে টেকনোলজি সমৃদ্ধ ওয়াকান্ডার সম্প্রীতির হাত বাড়িয়ে বলে
Wakanda will no longer watch from the shadows. We can not. We must not. We will work to be an example of how we, as brothers and sisters on this earth, should treat each other. Now, more than ever, the illusions of division threaten our very existence. We all know the truth: more connects us than separates us. But in times of crisis the wise build bridges, while the foolish build barriers. We must find a way to look after one another, as if we were one single tribe.
কিলমংগারকে ভিলেন না ভেবে এন্টিহিরো বলতে চাই। চরিত্রটিকে এত নিখুঁতভাবে কূগলার উপস্থাপন করেছেন যে তার মৃত্যুতে গোত্রের অনেকের চোখে পানি চলে এসেছে। সত্য কথাটি হল গোত্র বলে আলাদা করছি না। কথায় চলে এসেছে। এর দায়ভার পরিস্থিতি ও ভাষাকেই নিতে হবে। পূর্বপুরুষদের প্রতি আফ্রিকানদের এক অন্যরকম আকর্ষণ রয়েছে। পূর্বপুরুষদের উপস্থিতি তাদের মত করে কোন জাতি উপলব্ধি করতে পারবে কিনা জানা নেই। হয়তো এজন্যই প্রিয় নায়ক জর্ডানকে ছবিতে মরতে দেখতে হয়েছে। এরিকের মৃত্যুকালের কথাটিও অনেকটা তাৎপর্যময়। টি’চালা তাকে সুস্থ করে তোলার অনুরোধে এরিক তার মুখে এক প্রশ্ন ছুড়ে মারে-
Why, so you can lock me up? Nah. Just bury me in the ocean with my ancestors who jumped from ships, ’cause they knew death was better than bondage.
৯১তম অস্কারের (আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য) সেরা চলচ্চিত্রের ক্যাটেগরিতে মনোনীত হয়েছে কূগলারের “ব্লাক প্যান্থার”। এর আগে সুপারহিরো নির্ভর কোন চলচ্চিত্র একাডেমী এ্যাওয়ার্ডে এতটা সম্মানিত হয়নি। সমালোচকরা হয়তো বলবেন যে এটা অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র ক্যাটাগরি পাওয়ার মত কোন সিনেমা না, এর থেকেও ভালো সিনেমা রয়েছে। হয়তো তাই। কারণ আঠারো’র অনেক সিনেমাই এখনো অদেখা। আবার এটাও অস্বীকার করতে পারবেন না যে সিনেমাটি অস্কারের একদমই হকদার না। কারণ আগেই বলেছি- সিনেমাটি কল্পিত চরিত্র ও গল্পের উপর নির্মিত হলেও, এর ভাবগাম্ভীর্যতা অবশ্যম্ভাবী। ফলাফল যাই হোক না কেন- ওয়াকান্ডা ফরেভার! ওয়াকান্ডা জিন্দাবাদ!