স্টাফ রিপোর্টার
উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে ‘নূর মোহাম্মদ নগর’। ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ নড়াইল সদর উপজেলার মহিষখোলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে- নূর মোহাম্মদ নগর। তাঁর স্মরণে এখানে নির্মিত হয়েছে-‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’, ‘স্মৃতিস্তম্ভ’, ‘স্টেডিয়াম’, ‘স্কুল এবং কলেজ’।
নড়াইল শহর থেকে প্রায় ১১কিলোমিটার দূরে ‘বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মহাবিদ্যালয়’ চত্বরে স্থানীয় সরকার বিভাগের অর্থায়নে এবং জেলা পরিষদের বাস্তবায়নে ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে-গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল (অব:) আবু ওসমান চৌধুরী ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। এদিকে, ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নূর মোহাম্মদের বসতভিটায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া ১৯৯৯ সালে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ২০০৫ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এছাড়া নূর মোহাম্মদের চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে এসএম গোলাম মোস্তফা কামাল ও মেয়ে হাসিনা বেগমের জন্য যশোরের নীলগঞ্জে একতলা করে দু’টি বাড়ি এবং অপর দুই সন্তান সুফিয়া রহমান ও রোকেয়া রহমানের জন্য নড়াইলের কুড়িগ্রাম এলাকায় একতলা করে আরো দু’টি বাড়ি সরকারের পক্ষ থেকে অনেক বছর আগেই নির্মাণ করা হয়েছে। অপরদিকে, নড়াইলের একমাত্র স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে-‘বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্টেডিয়াম’।
এ ব্যাপারে ‘বীরশ্রেষ্ঠ, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রজন্ম সংগ্রামী ঐক্য পরিষদ’ এর কেন্দ্রীয় সভাপতি নূর মোহাম্মদের ছেলে এসএম গোলাম মোস্তফা কামাল বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের সন্তান হিসেবে আমরা গর্বিত। আমাদের গ্রামের নাম পরিবর্তন করে বাবার নামে নামকরণ হয়েছে। এছাড়া নূর মোহাম্মদ নগরে বাবার নামে স্কুল, কলেজ, স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন ধরণের ক্লাব ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বীরশ্রেষ্ঠের সন্তান হিসেবে সরকার থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পেয়ে থাকি। দেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠের সন্তান, পরিবার-পরিজন নিয়ে গঠিত সংগঠন-বীরশ্রেষ্ঠ, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রজন্ম সংগ্রামী ঐক্য পরিষদেরও কেন্দ্রীয় সভাপতি মনোনীত করা হয়েছে নূর মোহাম্মদ সন্তান হিসেবে। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের তিন মেয়ে হাসিনা বেগম, সুফিয়া রহমান ও রোকেয়া রহমান বলেন, বাবার সন্তান হিসেবে আমরা যথেষ্ট মর্যাদা ও আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছি। আমাদের মা বেগম ফজিলাতুন্নেসাও বেঁচে থাকাকালীন যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছেন।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক ইউনুস শেখ বলেন, এখানে ইতিহাস-ঐহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে বই রয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। নূর মোহাম্মদের ব্যবহৃত একটি বাইসাইকেল স্মৃতি জাদুঘরে রয়েছে। স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বই ও পত্রিকা পড়েন।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মা জেন্নাতুন্নেছা, মতান্তরে জেন্নাতা খানম। বাল্যকালেই বাবা-মাকে হারান তিনি। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার দুই স্ত্রীর কেউই বেঁচে নেই। বর্তমানে এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।
নূর মোহাম্মদ শেখের জীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগদান করেন। বর্তমানে ‘বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ’ (বিজিবি)। দীর্ঘদিন দিনাজপুর সীমান্তে চাকরি করার পরে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই যশোর সেক্টরে বদলি হন তিনি। ল্যান্স নায়েকে পদোন্নতি পান।
১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল (অব:) আবু ওসমান চৌধুরী এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এস এ মঞ্জুর। নূর মোহাম্মদ যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নের্তৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ শত্রুমুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোর জেলার গোয়ালহাটি ও ছুটিপুরে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এদিন পাকবাহিনীর গুলিতে সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া গুরুতর আহত হলেও হাতে এলএমজি এবং আহত নান্নুকে কাঁধে নিয়ে শত্রু পক্ষের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকেন নূর মোহাম্মদ। হঠাৎ পাকবাহিনীর মর্টারের আঘাতে তার হাঁটু ভেঙ্গে যায়। তবুও গুলি চালাতে থাকেন তিনি। এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নূর মোহাম্মদ শেখ। যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
এদিকে, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের দ্বিতীয় স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা (৭৯) বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এর আগে ১৯৯০ সালে নূর মোহাম্মদ শেখের প্রথম স্ত্রী তোতাবিবি মারা যান।