বন্দে আলী মিয়া
হযরত আদম আলাইহিস সালামের বংশধরগণ ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর চারিদিকে পরিব্যপ্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু ধর্মের প্রতি, আল্লাহতা’লার প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণই ছিলো না। তারা দিনে দিনে অনাচারী ও পাপাচারী হয়ে উঠতে লাগলো। শেষে এমন অবস্থা হলো –পরশ্রীকাতরতা, পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা, ঝগড়া ও মারামারি তাদের নিত্য-নৈমিত্তিক কর্মের মধ্যে পরিগণিত হয়ে পড়লো। সর্বদা পাপাচরণ করা এবং পাপকার্যে ডুবে থাকা তাদের প্রকৃতি হয়ে উঠলো। তাদের ধর্মপথে আনবার জন্য আল্লাহতা’লা নূহ নবীকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি নানা ধর্মোপদেশ দিয়ে তাদের সৎপথে আনবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলেন; কিন্তু কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত মাত্র করলো না। বরঞ্চ হাসি-মস্করা করে এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাঁকে বেয়াকুব বানাবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তিনি হতাশ হলেন না। কেমন করে কাফেরদের ধর্ম পথে আনা যায় সেই কথা তিনি দিন রাত ভাবতেন। তিনি বার বার তাদের উপদেশ দিতে লাগলেন। কিন্তু তারা উত্যক্ত হয়ে মাঝে মাঝে তাঁকে প্রহার এবং নির্যাতন করতে শুরু করলো। নির্মম প্রহারের ফলে কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। হুঁশ হলে পুনরায় পাপাচারীদের সদুপদেশ দিতেন। এমনি করে অনেকদিন কেটে গেলো। অবশেষে তিনি হতাশ ও বিরক্ত হয়ে খোদার দরগায় হাত তুলে প্রার্থনা জানালেনঃ হে রহমান রহিম, আমি তোমার আদেশ বহন করে কাফেরদের মধ্যে এসে তাদের ধর্ম পথে আনবার জন্য সহস্র প্রকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা আমাকে গ্রহণ করেনি –তোমাকে মর্যাদা দেয়নি। তোমার পুনরাদেশের প্রতীক্ষায় আমি রয়েছি। তুমি আমার কর্তব্য নির্ধারণ করো।
তাঁর প্রার্থনা খোদার আরশে গিয়ে পৌঁছালো। তিনি জিবরাইল ফেরেশতাকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। জিবরাইল নূহকে খবর দিলেনঃ খোদাতা’লা দুনিয়ার ভার আর সহ্য করতে পারছেন না, তিনি শীঘ্রই মহাপ্লাবন দ্বারা দুনিয়া ধ্বংস করবেন বলে স্থির করেছেন। তিনি তোমাকে এবং তোমার পুত্র-কন্যাদের অতিশয় স্নেহ করেন। তাই তোমাদের রক্ষা করবার ব্যবস্থা তিনি করেছেন।
নূহ প্রশ্ন করলেনঃ কি করে আমরা রক্ষা পাবো?
জিবরাইল জবাব দিলেনঃ একটা মস্ত বড় জাহাজ নির্মাণ করো, তারপর কি করতে হবে পরে জানতে পারবে।
জিবরাইলের পরামর্শ অনুযায়ী নূহ জাহাজ তৈরি করতে লাগলেন। অনেক দিন ধরে অনেক পরিশ্রম ও পরিকল্পনায় একটি জাহাজ নির্মাণ সমাপ্ত হলো। জাহাজটি এত বড় হয়েছিলো যে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ তেমনটি দেখেনি। লম্বায় দু’হাজার হাত এবং চওড়ায় আটশ’ হাত আর উঁচু হয়েছিল ছয়শ’ হাত।
জাহাজ প্রস্তুত হয়ে গেলে জিবরাঈল একদিন দেখতে এলেন। নূহ তাকেঁ জিজ্ঞাসা করলেনঃ আমি কেমন করে জানতে পারবো কোন দিন মহাপ্লাবন আরম্ভ হবে? আর সে সময় আমাকে কি করতে হবে?
জিবরাইল বললেনঃ যখন রান্নার চুল্লি থেকে হু হু করে পানি উঠবে তখন বুঝবে যে মহাপ্লাবনের আর দেরী নেই। তখন তুমি যত প্রকার পশুপক্ষী আছে প্রত্যেক জাতের এক এক জোড়া জাহাজে তুলে নেবার ব্যবস্থা করবে। তারপর তোমার পরিবার ও সন্তান-সন্ততিসহ জাহাজে উঠবে।
কয়েকদিন পরে এক অপরাহ্নে কায়েররা নূহের কাছে এসে বললোছ জাহাজ তো তৈরি করলে নূহ সাহেব, কিন্তু এর দ্বারা করবে কি? কাছে তো নদী সাগর কিছু নেই তোমার জাহাজ ভাসবে কোথায়? মাটির ওপর দিয়ে তোমার জাহাজ চলবে নাকি? এই জাহাজে চড়ে তুমি ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যাবে নাকি? –এই বলে তারা নিজেদের রসিকতার দাঁত বের করে হো হো হাসতে হাসতে চলে গেল।
নূহ একদৃষ্টে তাদের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেনঃ খোদা, সৎপথে আসবার মতো বুদ্ধি এদের দাও।
একদিন নূহ নবীর স্ত্রী ভাত রাঁধছিলেন। এমন সময় জ্বলন্ত চূলা থেকে হু হু করে পানি উঠতে লাগলো। তিনি ছুটে গিয়ে স্বামীকে এ সংবাদ জানালেন, নূহ বুঝত পারলেন প্লাবর আর বেশি দেরি নেই। তিনি সকল রকম পশু-পক্ষী এক এক জোড়া জাহাজে তুলবার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর কাজ শেষ হলে আল্লাহতা’লা আসমানের দরজা খুলে দিলেন। ঝম ঝম করে অজস্র ধারায় অবিরাম বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। চল্লিশ দিন অবিরাম বৃষ্টি। গাছপালা ঘরবাড়ি পাহাড় পর্বত সমস্ত ডুবে একাকার হয়ে গেলো।
নূহের জাহাজ পানির উপর ভেসে বেড়াতে লাগলো। একদিন দু’দিন করে এক মাস ক্রমে ছয় মাস আটদিন অতিবাহিত হয়ে গেলো। দুর্যোগ কেটে সুবাতাস বইতে আরম্ভ করলো। আস্তে আস্তে পানি কমতে শুরু করলো।
জাহাজ তখনো এদিক-ওদিক চলছিল! চলতে চলতে একদিন জুদী নামক একটি পাহাড়ে জাহাজ এসে ঠেকলো। জাহাজ থেকে নামবার সময় হয়েছে কিনা নূহ বুঝতে না পেরে দাঁড়কাক দু’টিকে ছেড়ে দিলেন। চারদিকে পচা জীব-জন্তুর মৃতদেহ পেয়ে দাঁড়কাকেরা মনের আনন্দে তা ভক্ষণ করতে লাগলো। সুতরাং জাহাজে ফিরে যাবার কথা আর তাদের মনেই রইলো না।
দাঁড়কাকের সম্বন্ধে হতাশ হয়ে নূহ পায়রাদের ছেড়ে দিলেন। পায়রারা কিছুক্ষণ পড়ে কচি পাতা সুদ্ধ একটি ডাল ঠোঁটে করে নিয়ে আবার জাহাজে ফিরে এলো। নূহ বুঝতে পারলেন পানি কমে গেছে এবং গাছে কচি পাতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এ থেকে তিনি অনুমান করতে পারলেন না যে, এখন জাহাজ থেকে নামবার সময় হয়েছে কি না। অতঃপর তিনি একটি মোরগকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিলেন। পানি একেবারে কমে যাওয়ায় মাটির ওপরে নানা রকম মরা পোকা-মাকড় দেখতে পেয়ে সে আর জাহাজে ফিরে গেলো না। এবারে নূহ বুঝতে পারলেন যে, পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে, এখন জাহাজ থেকে নামবার সময় হয়েছে। আদেশ না পেলে তো জাহাজ থেকে অবতরণ করতে পারেন না। সুতরাং তিনি প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।
আরো দিন কয়েক কেটে যাবার পর একদিন জিবরাঈল এসে তাঁকে জাহাজ থেকে নামনে বললেন। তাঁরকথামত নূহ তাঁর পরিবারবর্গ এবং জন্তু-জানোয়ার প্রভৃতি নিয়ে জাহাজ থেকে নামলেন। এবারে তিনি যেন নতুন দুনিয়া দেখলেন। খোদা যেন মহাপ্লাবন দিয়ে ধরনীর সমস্ত পাপ একেবারে ধুয়ে-মুছে দিয়েছেন। তিনি সুখ ও সম্ভোগের সঙ্গে পুনরায় বসবাস করতে আরম্ভ করলেন।