অভিজিৎ কর্মকার
১৫৯৯ সাল। ইংরেজ বণিকেরা ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের সনদ নিয়ে হেক্টর নামের ২৫ টনির একটি বাণিজ্য তরীতে ভর করে ইংল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সুদীর্ঘ সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে ১৬০০ সালের ২৪ আগস্ট তারা নোঙর ফেলেন বোম্বাইয়ের সুরাট বন্দরে। দিল্লীর মসনদে তখন ক্ষমতায় ছিলেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর। ভারতবর্ষে আগমনের সময় ইংরেজ বণিকেরা সম্রাট জাহাঙ্গীরের জন্য দূরদেশ থেকে বয়ে নিয়ে আসেন নানা উপহার সামগ্রী। ইংরেজ বণিকদের ২৫ টনি হেক্টর বাণিজ্য তরীর অধিনায়ক উইলিয়াম হকিন্স ইল্যান্ড থেকে বয়ে আনা সেইসব উপহার সামগ্রী সমেত হাজির হন সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে। চতুর ইংরেজ বণিকদের উদ্দেশ্য ছিল সম্রাটকে তুষ্ট ও তোষামদ করে ভারতবর্ষে ব্যবসা বাণিজ্য করার অনুমতি ও সনদ বাগিয়ে নেওয়া। চতুর ইংরেজ বণিকদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সরল মনে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে ব্যবসা করার অনুমতি ও সনদ দেন। ১৬০০ সালে বাংলার মাটিতে গোড়পত্তনের সূচনালগ্নে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মূলধন ছিল ৭২০০০ পাউন্ড, শেয়ার হোল্ডার ছিলেন ১২৪ জন।
১৬০০ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল, বাংলার মাটিতে এসে ইংরেজরা জল ঘোলা করে একের পর এক মাছ শিকার করতে থাকে। ১৬৩৯ সালের শেষ দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাদ্রাজে সমুদ্র বন্দর তৈরির অনুমতি লাভ, ১৬৫০ সালে মোগল সম্রাট শাজাহানের কাছ থেকে ফরমান আদায়। ১৬৫১ সালে হুগলীতে প্রথম বাণিজ্য কুঠি নির্মান করার পর ধারাবাহিকভাবে উড়িষ্যা ও বাংলাদেশে মেদনীপুরে বাণিজ্য কুঠি নির্মান করে চলে
ইংরেজরা।
এভাবে নিজেদের ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলে তারা এবং চূড়ান্তভাবে ভারতবর্ষ দখল করে নেয় ১৭৫৭ সালে। ১৭৬০ সাল থেকে স্বাধীন ভারতবর্ষে পাকাপাকিভাবে শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন ও ইংরেজদের প্রভুত্ব। কিন্তু পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধে যেভাবে ইংরেজরা নবাব সিরাজুদ্দৌলার শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেছিল তা ছিল শুধুই নামমাত্র যুদ্ধ।
১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে নবাব আলীবর্দি খান মৃত্যুবরণ করেন। নবাব আলীবর্দি খানের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তিন কন্যার মধ্যে ছোট কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজুদ্দৌলাকে নবাব আলীবর্দি খান সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। ফলে আলীবর্দি খানের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হিসাবে মসনদে বসেন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সিংহাসনে আরোহনকে কেন্দ্র করে আলীবর্দি খানের অপর দুই জৌষ্ঠ কন্যা ঘষেটি বেগম ও শাহ বেগম রুষ্ট হন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা ১৭৫৬ সালের ১৫ এপ্রিল শাসনভার গ্রহনের মাত্র এক বছর দুই বছরের মাথায় চক্রান্তের শিকার হয়ে নির্মমভাবে নিহত হন।
(২) ২৬০ বছর পূর্বে মুর্শিদাবাদ ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর অম্রকাননে নবাব বাহিনীর সাথে ইংরেজদের যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেটি ছিল প্রহসনের যুদ্ধ। নবাবের কিছু বেঈমান সেনাপতির ইংরেজদের সাথে সমঝোতা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নির্মমভাবে নিহত হন নবাব সিরাজুউদৌল্লো। নবাব বাহিনীর সৈন্যের সংখ্যা ছিল ৫৬ হাজার পক্ষান্তরে ইংরেজ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল নবাব বাহিনীর সৈন্যের তুলনায় দশগুণ কম। পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ বাহানীর সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের সাথে ছিল ২৫০ জন ইউরোপীয় সৈন্য, ৫০ জন নাবিক, ১০০ জন আধা ইউরোপীয় সৈন্য, ১৫০ জন গোলন্দাজ, ৮ টি কামান ও ২১০০ জন সিপাহী।
পলাশী প্রান্তরে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজুদ্দৌলার ৫৬ হাজার সৈন্য থাকা সত্বেও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল মাত্র ১২ হাজার সৈন্য। নবাবের বাকি সৈন্যরা সব মীরজাফর, রায়দুর্লভ, জগতশেঠের কথা মোতাবেক হাত গুটিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছিল। ১৫৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাবের সৈন্যরা যদি যুদ্ধের ময়দানে দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে না থেকে ইংরেজে বাহিনীর সৈন্যদের উপর একটি করে ঢিল ছুঁড়তো, তাহলে বাংলার আকাশের স্বাধীনতার সূর্য সেদিন অস্তমিত যেত না।
মীরজাফররে সবুজ সংকেত পেয়ে, নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় নিশ্চিত জেনে, ইংরেজে বাহিনীর সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ ১৩ জুন ১৫৫৭ কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন। কলকাতা থেকে মুর্শিবাদ আসার পথে নবাবের কোন শক্তিশালী দুর্গ না থাকায় কোনরূপ বাধা বিপত্তি ব্যতিরেক ২২ জুন রাত ১২ টা নাগাদ ক্লাইভ বাহিনী ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে আস্তানা
গাড়ে। আমবাগানের সন্নিকটে অবস্থিত পলাশী হাউজ দখল করে নেন। ১৭৫৭ সালে ২৩শে জুন বৃহস্পতিবার পলাশীর প্রান্তরে ভোর ৭ টায় নবাবের বিশাল বাহিনীর সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হয়। সকাল ৭ টা থেকে সকাল ১০ টা (মাত্র ৩ ঘন্টার মধ্যে) ইংরেজ বাহিনী কোনঠাসা হয়ে যায়। ১১ টা নাগাদ ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে যুদ্ধ স্তিমিত হয়।… ঝড় বৃষ্টির কারণে নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ ভিজে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেলে নাবাব বাহিনীর সেনাপতি মীর মদন অশ্ব ও সৈন্য
নিয়ে ইংরেজদের উপর আক্রমন চালায়। ইংরেজরা তাদের গোলাবারুদ বৃষ্টির মধ্যেও সুরক্ষিত রাখায় নবাব বাহিনীর উপর গোলাবারুদ ও কামান দিয়ে হামলা চালালে বহু সৈন্য হতাহত হয় এবং মীরমদনের উরুতে আঘাত লাগে। মীরমদনকে আহত অবস্থায় নবাবের শিবিরে নিয়ে আসা হলে মীরমদন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বিশ্বস্ত মীরমদনের মৃত্যুতে নবাবের মনোবল ভেঙে যায়। মীরমদন নবাবের পক্ষ হয়ে ইংরেজদের বিপক্ষে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করলেও নবাবের পক্ষের লোক হয়েও (ইতিহাসের মহা বেঈমান) মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লতিফ তাঁদের বাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। মীরজাফরকে নবাব সিরাজুদ্দৌলা তাঁর দরবারে ডেকে এনে মাথার মুকুট মীর জাফরের হাতে তুলে দিয়ে বাংলার সম্মান বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করেন। নবাবের সামনে মীরজাফর অনুগত থাকার অভিনয় করে নবাবকে সে দিনের মতো যুদ্ধ থামনোর কুমন্ত্রনা দেন। পলাশীর ময়দানে তখন মোহনলাল নবাবের পক্ষে হয়ে ইংরেজ বিরুদ্ধে লড়ে এগিয়ে থাকলেও নবাবের আদেশে যুদ্ধ ময়দান থেকে তার বাহিনী নিয়ে ফিরে আসেন। দুপুর ২ টা নাগাদ দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ থেমে যায়। মীরজাফরের গোপন চিঠি পেয়ে অপ্রস্তুত নবাব বাহিনীর উপর দুপুর ৩ টা নাগাদ ইংরেজ সৈন্যরা অতর্কিত কামান ও গোলাবারুদ নিয়ে হামলা চালালে নবাব বাহিনীর সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তখন বিনা বাধায় নবাব শিবিরে ঢুকে পড়ে ইংরেজরা।
(৩) মাত্র ১১ ঘন্টার প্রহসনের যুদ্ধে ১৭৫৭ সালে ভাগীরথী নদী সংলগ্ন পলাশীর প্রান্তরে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার সূর্য ১৯০ বছরের জন্য অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল। অতীত ইতিহাস আজও সাক্ষী দেয় সেদিন পলাশীর প্রান্তরে ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ ও মীর জাফরের গা শিউরে ওঠার মতো নিলজ্জতা ও নেকমহারমীর কাহিনীর! যাদের চক্রান্তে নিহত হন নবাব। মীর জাফরের পুত্র মীরণ, যুদ্ধে সদ্য পরাজিত বন্দী নবাব সিরাজুদৌল্লাকে হত্যা করার জন্য অনেককেই বলেছিল। কিন্তু বন্দী নবাবকে হত্যা করার জন্য কোনো আমীর ওমরাও সেদিন যখন রাজী হননি। তখন নির্মমভাবে নবাবকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছিল মোহাম্মদী বেগ। নবাবের হত্যাকারী এই অকৃতজ্ঞ মোহাম্মদী বেগের প্রতিপালক ছিলেন স্বয়ং নবাবের পিতা-মাতা। নির্মম হলেও সত্য এটা যে, নবাবের পিতা-মাতা ও আলিবর্দী খাঁর আদর, যত্ন ও স্নেহে বেড়ে উঠা মোহাম্মাদী বেগ অবশেষে পালক পিতা-মাতার সন্তান নবাবকে হত্যা করে এভাবেই তাদের ভালোবাসা ও উপকারের প্রতিদান দিয়েছিল। বাংলার মানুষের কাছে মীর জাফর এই নামটি এখন বেঈমান শব্দটির প্রতিশব্দ হয়ে গিয়েছে। কেননা, মীরজাফর পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ ছুঁয়ে পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েও সে তার কথা রাখেনি। মীর জাফরের চক্রান্তেই ইংরেজরা নবাবের সেনাবাহিনীকে পরাস্থ করতে সক্ষম হয়। পলাশীর প্রহসনের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ছদ্মবেশ ধারণ করে নবাব সিরাজুদৌল্লা যখন নৌকায় করে তাঁর বেগম লুতফ-উন-নিসা ও কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন তাকে মীর জাফরের হাতে ধরিয়ে দেয় একদা তাঁরই অনুগত ফৌজদার ফকির দানাশা। ফকির দনশা নবাবকে ধরিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়। ফকরি দনশার এরকমটি করার কারণ ছিল, নবাব সিংহাসনে আসীন থাকাকালীন ফকির দনশার সাথে রূঢ় আচারণ করেছিলেন এবং তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। নবাবেকে নির্মমভাবে হত্যার পর চূড়ান্তভাবে ইংরেজদের করতলগত হই আমরা। পরাধীনতা কালো মেঘে ছেয়ে যায় বাংলার আকাশজুড়ে।