মাশরাফীঃ কিছু মানুষের জন্য নিরীহ মানুষ কষ্ট পাবে এটা সহ্য করা হবে না

3
71

স্টাফ রিপোর্টার

খেলার মাঠে ক্রিকেট বল হাতে ঝড় তোলেন টাইগার ক্যাপ্টেন মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। এবার তিনি ঝড় তুললেন সাংসদ হিসেবে। দু’দিনের সফরের মাশরাফীকে নড়াইলবাসী অন্যরকম এক ভিন্ন চেহারায় দেখেছেন। নির্বাচনী এলাকার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। কখনো মোটর সাইকেলে আবার কখনো মাইক্রো গাড়িতে। নড়াইলের সাংসদ মাশরাফীর রোগী সেজে হাসপাতালের চিকিৎসককে ফোন করেন। অপরদিকে ঝটিকা সফরে রোগীদের কাছে পৌঁছে যান। খেলোয়াড় হিসেবে যেমন নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য খেলেন। তেমনি জনপ্রতিনিধি মাশরাফীকে নড়াইলবাসী দেখলেন দেশপ্রেমিক এক চরিত্রে।

জাতীয় দলের ক্যাম্পে যোগদানের আগে দু’দিনের নির্বাচনী এলাকায় সফরে মাশরাফী চিকিৎসা বিভাগকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। কাউকে কিছু না জানিয়ে বৃহস্পতিবার সাড়ে ৩টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টানা ২ ঘন্টা নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে ঝটিকা সফর করেন নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। নারী ও শিশু ওয়ার্ডে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের সমস্যার কথা শোনেন। ওই সময় পুরো হাসপাতালে মাত্র একজন ডাক্তারের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি।

সদর হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে মাত্র ২জন নার্স দেখে তাদের ডিউটির ব্যাপারে খোজ খবর নেন। হাসপাতালে পর্যাপ্ত নার্স থাকলেও ১-২জন নার্স দিয়েই বিভিন্ন ওয়ার্ড পরিচালিত হচ্ছে। ঘটনা শুনে তৎক্ষনাৎ দ্বোতালা থেকে নিচে নেমে আসেন এবং নার্সিং সুপারভাইজারদের খোঁজ করেন মাশরাফি। নার্সদের কক্ষে তালা দেখতে পেয়ে টেলিফোনে দায়িত্ব প্রাপ্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। এসময় একজন সুপারভাইজারের ফোন বন্ধ এবং অপরজনের ফোন খোলা থাকলেও তিনি রিসিভ করেননি।

রোগীদের অনুরোধে হাসপাতালের বাথরুম ও তার পরিবেশ নিজে দেখেন এবং মোবাইলে ছুবি তুলে নেন। কয়েকটি বাথরুমের দরজা ভাঙ্গা এবং দূর্গন্ধ তাকে অত্যন্ত বিব্রত করে তোলেন।তখন তিনি এ ব্যাপারে জানার জন্য আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারকে ফোন করতে বলেন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর বিথী খাতুন এসময় অফিসে উপস্থিত থেকে মাশরাফীর নানা প্রশ্নের জবাব দেন। মাশরাফি জানতে পারেন, হাসপাতালের চিকিৎসক সংকট থাকলেও নার্সের কোনো সংকট নেই। এই মুহূর্তে ৭৩জন নার্স রয়েছে ওই হাসপাতালটিতে।

এরপর মাশরাফী পুনরায় দোতলায় এসে ডাক্তারদের অবস্থান জানতে চেয়ে হাজিরা খাতা দেখেন। হাজিরা খাতায় সার্জারী চিকিৎসক সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা.আকরাম হোসেনের ৩ দিনের অনুপস্থিতির প্রমাণ পেয়ে ছুটির আবেদন দেখতে চান। পরে জানতে পারেন ছুটি ছাড়াই ওই ডাক্তার ৩দিন অনুপস্থিত।

এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে টাইগার ক্যাপ্টেন প্রথমে রোগী সেজে ওই চিকিৎসককে ফোন করলে তিনি রোগীকে অর্থাৎ মাশরাফিকে রোববার হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে বলেন। এ সময় নিজের পরিচয় দিয়ে মাশরাফী ডাক্তারকে বলেন, ‘এখন যদি হাসপাতালে সার্জারী প্রয়োজন হয় তাহলে সেই রোগী কি করবে?’ এরপর তিনি ওই ডাক্তারকে তার কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্রুত কর্মস্থলে ফিরে আসার নির্দেশ দেন।

মাশরাফীর হাসপাতালে আসার খবর পেয়ে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা.মশিউর রহমান বাবু ও ডা.আলিমুজ্জামান সেতু হাসপাতালে ছুটে আসেন । এসময় চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি বিষয়ে কথা বলে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারকে দিয়ে হাজিরা খাতায় ওই চিকিৎসক ডা.আকরাম হোসেনের ৩দিনের অনুপস্থিত করিয়ে নেন।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে বসে মাশরাফী তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ আব্দুস সাকুরকে ফোন করেন। সে সময় তিনি খুলনায় একটি সভায় অংশগগ্রহন শেষ করে মাগুরায় বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। স্টেশনে অবস্থান করার কথা জানিয়ে রাতের মধ্যেই তাকে হাসপাতালে চলে আসতে বলেন মাশরাফি। তখন তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ আব্দুস সাকু একঘন্টার মধ্যেই সদর হাসপাতালে চলে আসেন।

এরপর হাসপাতালের নানা স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন এমপি মাশরাফি। তখন এক অন্যরূপ দেখে মাশরাফীর। এমপি সাহেবরা যে এমন রূপ ধারণ করতে পারেন এটা না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতো না নড়াইলবাসী। উপস্থিত সাধারণ মানুষের মধ্যে এসময় আনন্দের হাসি দেখা গেলেও হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তারা নিজেদের দোষ ঢাকতে তখন ব্যস্ত। আবর্জনায় পরিপূর্ণ ড্রেন এবং নানা নোংরা পরিবেশ দেখে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মশিউর রহমানের কাছে দূরাবস্থার কারণ জানতে চাইলে তিনি নড়াইল পৌরসভার ওপর দায় চাপিয়ে কোনো রকমে রেহাই পান।

এসময় উপস্থিত দুই চিকিৎসক এবং কর্মকর্তা মাশরাফির কাছে এই সকল ঘটনার খবর মিডিয়ায় প্রকাশ না করার জন্য উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন। হাসপাতালের সংক্রামক ওয়ার্ডে গেলে রোগীরা নানা অভিযোগ করেন সংসদ সদস্যের নিকট। ‘বাইরে থেকে স্যালাইন কিনে আনতে হয়’- এমন অভিযোগ শুনে তিনি হাসপাতালের বাইরের দোকানগুলোতে সরকারী স্যালাইন বিক্রি করা হয় কি-না তা দেখার জন্য নির্দেশ দেন। হাসপাতালের ঔষধ সংকট শুনে স্টোর কিপারকে ডাকেন, পরে তাকে না পেয়ে রাতে আবার সভা করবেন বলে বেরিয়ে যান।

একই বিষয় নিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, সিভিল সার্জন, ডাক্তার,নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে সভা করেন সাংসদ মাশরাফি। এসময় তার সঙ্গে জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন,এছাড়াও হাসপাতালের অবকাঠোমো দেখভাল করা প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত বিভিন্ন মানুষের নিকট থেকে প্রাপ্ত নানাবিধ অভিযোগ এবং নিজের দেখা অনিয়মের ব্যাপারে তিনি সকলের সঙ্গে রূদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এসময় হাসপাতালের নানা অনিয়মের মধ্যে বাইরের অ্যাম্বুলেন্স, দালাল এবং বিক্রয় প্রতিনিধিদের কঠোর ভাবে দমনের নির্দেশ দেন। তিনি হাসপাতালকে মানুষের সেবার জন্য উন্মুক্ত করতে বলেন।

নড়াইল সদর হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনা বিষয়ে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মশিউর রহমান বাবু বলেন, ‘হাসপাতালের প্রধান সমস্যা হলো চিকিৎসক সংকট। আমরা যে কয়জন আছি তারা প্রত্যেকে যদি একশ ভাগ সেবা দেই তাহলে অবস্থার উন্নতি হবে। পরিচ্ছন্ন কর্মী সংকট এবং পৌরসভার সহযোগিতা না করার কারণে ময়লা-আবর্জনা সরানো সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।’

সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ আব্দুস শাকুর বলেন, ‘গত বুধবার (২৪ এপ্রিল) এই হাসপাতালে আমি যোগদান করেছি। আমি এখানে এসেই কয়েকজন চিকিৎসকের গাফিলতি লক্ষ্য করেছি। এমপি সাহেব যেভাবে আজ দেখলেন, আর যা বললেন তাতে আমার কাজটি অনেক সহজ হয়ে গেল। এখন আর কেউ আমার বিরুদ্ধে দল পাকাতে পারবে না।’

নিজের পরিদর্শনের ব্যাপারে সংসদ সদস্য মাশরাফী বলেন, ‘সাধারণ মানুষের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো চিকিৎসা। এসেবার মান নিশ্চিত করতে আমার যা কিছু করার আমি সবই করবো। কিছু মানুষের জন্য নিরীহ মানুষ কষ্ট পাবে এটা সহ্য করা হবে না।’

এমন ভূমিকায় দারুন প্রশংশিত হয়েছেন সচেতন মহলে নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। এ উদ্যোগ নিয়ে ইতোমধ্যে ফেসবুকে প্রচুর প্রশংসিত কমেন্ট পেয়েছেন। এফ এম আমিরুল ইসলাম তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, নড়াইলের মানুষের স্বপ্ন পূরনের কান্ডারী আমাদের সবার প্রিয় মাশরাফি এমপি। তিনি নড়াইলের মানুষের প্রত্যাশা পুরণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন যখনই খেলার অবসরে সময় পাচ্ছেন তখনই নড়াইলের জন্য কোথায় কার কাছে গেলে উন্নয়নে উপকার পাওয়া যাবে সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন।

ব্যস্ততার মাঝেও নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে যেতে ভুল করেননি সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘুরে এসেছেন হাসপাতালের সকল অনিয়ম বন্ধ করারও ঘোষণা দিয়েছেন। নড়াইলে সেবার মান চরম খারাপ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ৪৮ বছরে যেটা নড়াইলের মানুষ পায়নি সেটা এবার পাবে আর এটা মাশরাফী যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন এটা চলমান থাকবে। নড়াইলের সুধীসমাজ সাংবাদিক মহলসহ সকল শ্রেণীপেশার মানুষ নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার এমন কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এমন ভাবেই যেন এমপি নড়াইলের উন্নয়ন অব্যাহত রাখেন।