১৯৬৫ সালের কাশ্মীর নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ ও এর ফলাফল

0
85

কাশ্মীর সমস্যা বহুদিনের একটি অমীমাংসিত সমস্যা। ১৯৪৮ সনে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময়ে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পুনরায় ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দেশ বিভাগ থেকে এই সমস্যা উদ্ভূত হয়। জাতিসংঘ গণভােটের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে রায় দেয়। পাকিস্তান গণভােটের মাধ্যমে কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সমর্থন করে। কিন্তু ভারত নানাভাবে এই দাবি অগ্রাহ্য করে এবং কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করতে থাকে।

১৯৬৫ সনের আগস্ট মাসে পাকিস্তান কাশ্মীরীদের সমর্থনে মােজাহিদ বাহিনী বা অনুপ্রবেশকারী পাঠায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত উভয় দেশ বড় রকম যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ৬ই সেপ্টেম্বর ভারত পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে লাহাের অভিমুখে অগ্রসর হয়। এই যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের কৃতিত্বে লাহাের রক্ষা পায়। যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকরা শৌর্য-বীর্যের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। ফলে এতকাল ধরে বাঙালির বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদীরা ভীরুতা ও কাপুরুষতার যে কুৎসা, অপবাদ প্রচার করছিল তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সতের দিন ব্যাপী এই যুদ্ধ চলে। অবশেষে জাতিসংঘের নির্দেশে যুদ্ধবিরতি হয়।

অতঃপর সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মি. কোসিগিনের আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মিলিত হন এবং ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। শান্তিপূর্ণভাবে উভয় দেশ নিজেদের অমীমাংসিত সমস্যাগুলি সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটি তাসখন্দ চুক্তি’ নামে খ্যাত। কিন্তু যুদ্ধের মূল কারণ কাশ্মীর সম্পর্কে এই চুক্তিতে কোনাে উল্লেখ নেই। এই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১০ই জানুয়ারি, ১৯৬৬ খৃস্টাব্দ। যুদ্ধকালে দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারকে সমর্থন করে। কিন্তু শান্তিচুক্তি পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকে। স্বভাবত সেখানে বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে তাই শান্তি চুক্তির তীব্র প্রতিবাদ হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্নরূপ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিন্ন হয়।

পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত অবস্থায় সমগ্র বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রতিরক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় প্রতি মুহুর্তে এখানে নিরাপত্তার অভাব অনুভূত হয়। সেজন্যে এই অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিকভাবেই শান্তি চুক্তিকে অভিনন্দন জানায়। যুদ্ধের সময়ে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। খাদ্যসামগ্রী যথেষ্ট পরিমাণে মওজুদ না থাকায় খাদ্য সংকটের উপক্রম হয়। সরকারি উপেক্ষার ফল জনগণের নিকট প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এমতাবস্থায় যুদ্ধশেষে পূর্ব বাংলার সম্পদ অবাধে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষয়-ক্ষতি পূরণের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্গঠন বাবদ ট্যাক্সের মােটা বোঝা পূর্ব বাংলার কাঁধে চাপানাে হয়। অথচ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে এই অঞ্চল নানাভাবে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনা ও বৈষম্য সামাজিক শােষণ ও নিপীড়নের শিকারে পরিণত হয়। তা প্রতিকারের কোনাে ব্যবস্থা হয়নি।

যুদ্ধশেষে পূর্ব বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার নানান ষড়যন্ত্র চলতে থাকে সর্বতোভাবে। রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বেতারে নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারের এই হীন কারসাজির বিরুদ্ধে দেশের জাগ্রত বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র সমাজ তীব্র প্রতিবাদ করে। যুদ্ধশেষে পূর্ববাংলার জনমনে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর উদাসীনতা ও দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। সেইসঙ্গে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিও জোরদার হতে থাকে। শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের এই ধমায়িত অসন্তোষের সদ্ব্যবহার করেন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুবের জনপ্রিয়তা দ্রুত হাস পায়। সেখানে তাসখন্দ চুক্তি বিরােধী আন্দোলন শুরু হয়। কারণ এই চুক্তিতে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের কোনাে উল্লেখ না থাকায়, জনগণ একে অপমানজনক চুক্তি বলে মনে করে। দেশের এই রাজনীতিক পরিস্থিতিতে বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৬৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহােরে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ‘নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্স’ আহ্বান করেন। শেখ মুজিব প্রথমে এই সম্মেলনে যােগদানে অসম্মতি জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবর্গের অনুরােধে তিনি সম্মেলনে যােগদান করেন।

এই লাহাের সম্মেলন চলাকালে শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা আমাদের মুক্তিসগ্রামের সনদরূপে স্বাধীনতা অর্জনের সুস্পষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা এর বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার চালায়। লাহাের সম্মেলন ব্যর্থ হয়। সম্মেলনের ব্যর্থতার জন্য কোনাে কোনাে নেতা শেখ মুজিবকে দায়ী করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের অগণতান্ত্রিক মনােভাবের জন্যই সম্মেলন সফল হয়নি।

শেখ মুজিব তার ৬ দফা দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলেন : সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলােকে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজনীয়তা প্রবলভাবে দেখা দেয়। দেশরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দাবি একান্ত বাস্তব ও অপরিহার্য। সেই বিষয়ে কারও দ্বিমতের অবকাশ নেই। তিনি আরও বলেন যে, দেশরক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় অঞ্চলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন (তৎকালীন) পাকিস্তানের (পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ) জাতীয় সংহতিকে আরও শক্তিশালী করবে। (সূত্রঃ বাংলাদেশের ইতিহাস, ২০১১)