ফারাক্কার প্রভাবে ভাঙছে নবগঙ্গা-মধুমতি

555
52

নিউজ ডেস্ক

নড়াইলের মধুমতি-নবগঙ্গা নদীতে মাত্রাতিরিক্ত পানি বেড়েছে ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ায়। নিচু এলাকা যেমন প্লাবিত হচ্ছে, তেমনি তীব্র ভাঙন দেখা গেছে মধুমতি-নবগঙ্গার বিভিন্ন এলাকায়। ভাঙনের কবলে পড়ে কয়েকবছরে মধুমতি নদীর ঘাঘা, মল্লিকপুর, শিয়েরবর, মাকড়াইল নবগঙ্গা নদীর করগাতি, ছোট কালিয়া, শুক্তগ্রামসহ ১৫টি পয়েন্টে হাজারো বসতঘর জমিসহ নানা স্থাপনা নদীগর্ভে চলে গেছে। ফারাক্কার প্রভাবে নতুন করে ভাঙতে শুরু করেছে নবগঙ্গা নদীর শুক্তগ্রাম-হাচলা আর মধুমতি নদীর তেতুলিয়া এলাকাসহ কয়েকটি এলাকা।

গত ৪/৫ দিনে শুক্রগ্রাম এলাকার বাজার এলাকায় নবগঙ্গা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। হঠাৎ ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শতাধিক বাড়িঘর ও ফসলি জমি। ভাঙন অব্যহত থাকলেও ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতায় গৃহহীন হয়েছে কালিয়া উপজেলার কয়েক শ’ বাসিন্দা। এখনও ভাঙন আতঙ্কে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ।

গত বছরে নবগঙ্গার তীব্র ভাঙনে বিলীন হয়েছে শুক্তগ্রাম এলাকার পালপাড়া, আশ্রয়ন প্রকল্পসহ কয়েক হাজার একর জমি। প্রতিনিয়ত ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নবগঙ্গা পাড়ের হাজারো মানুষ। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে প্রায় শতাধিক বাড়ি-ঘর গাছপালাসহ ফসলি জমি। ভাঙনের ভয়াবহতায় আশপাশের কয়েক এলাকার মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে ঘরবাড়ি, দালান-কোঠা, গাছপালা কেটে সরাতে শুরু করেছে।

শুক্রগ্রামের প্রবীণ ইলিয়াস আলী জানান, গত ৩৫ বছরে নবগঙ্গা নদীতে এমন পানি দেখিনি। এই পানি বাড়ার কারণে কয়েকদিনে আমাদের বাড়িটি এক রাতেই নদীর মধ্যে চলে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন যে বালির বস্তা ফেলছে তা নদীতে যাচ্ছে, ভাঙনে কোনো কাজে আসছে না।

অভিযোগ আছে নবগঙ্গার বিভিন্ন অংশে চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ভাঙনের আশঙ্কা থাকলেও স্থানীয়দের কোনো আবেদনে সাড়া দেয়নি জনপ্রতিনিধি কিম্বা পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ভাঙনের মধ্যে নদী থেকে বালি তুলে তা ভরে জিও ব্যাগ ফেলায় ব্যস্ত থাকলেও তা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের কবলে পড়ে বাস্তুহারা মানুষের শেষ সম্বল বাড়ি সরানোর কাজে ব্যস্ত থাকলেও প্রশাসনের লোকেরা তাদের খবরও নিচ্ছেন না, মানুষের খাবারও জুটছে না ঠিকমতো।

নবগঙ্গার ভাঙনে গ্রামটির বহু পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভাঙনের শিকার অসহায় পরিবারগুলো বাজারে, নদীর পাড়ে, রাস্তার পাশে ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। নদীর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে আবার রাস্তার ওপরে ছড়ানো ছিটানো ভাঙনের শিকার লোকদের ভাঙা বাড়ির চাল, আসবাবপত্র। কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবেন এমন জায়গা খুঁজছেন সবাই। ওপরে চাল নেই মাটির ভিটার ওপরেই আশ্রয় নিয়েছে কয়েকটি পরিবার।

এদের একজন জূলমত শেখ বলেন, আমাদের ঘর ভেঙে ফেলেছি গত ৫ দিন ধরে খোলা আকাশে বসবাস করছি, গ্রাম্য লোকেরা কিছু খাবার দিলে তাই খাচ্ছি, আমাদের আর যাবার কোনো জায়গা নেই। কোথায় যাব, কি খাব বুঝে উঠতে পারছি না।ভাঙনের শিকার চরপাড়ার ষাটোর্ধ্ব তোবারেক শেখ বলেন, তিনবার নদী ভাঙনে বাড়ি-ঘরসহ ৩৫ একর ফসলি জমি নদীতে গেছে। সর্বশেষ ২ একর ৫৬ শতক জমি ছিল বসতবাড়ি। ভাঙতে ভাঙতে এখন মাত্র ১৫ শতক জমি আছে, এখন আমরা নিঃস্ব।

গত বর্ষা মৌসুম থেকে তীব্র ভাঙনে নবগঙ্গা নদী গ্রাস করেছে শুক্তগ্রামের প্রায় দেড় শ’ বসতবাড়ি। এবার মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় তিন শ বছরের পরনো শুক্তগ্রাম বাজার। যেকোনো মুহূর্তে নদীপাড়ের পাকারাস্তাটি ভেঙে গেলে সরকারি স্থাপনাসহ মসজিদ, মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নবগঙ্গা নদীর শুক্তগ্রাম এলাকার ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়সারা কাজে কোনো ফল হয়নি। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় যেকোনো সময় নদীতে বিলীন হবে শুক্তগ্রাম বাজারসহ হাজারো বাড়িঘর। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে সাফাই গাইলেন বাবরা-হাচলা ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন পিকুল, তিনি বলেন, এটা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এবারের হঠাৎ ভাঙনে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে, আশা করি এই ভাঙন ঠেকানো যাবে।বর্ষা মৌসুমের শুরুতে কাজ না করে ভাঙনের মধ্যে ফেলা জিও ব্যাগ কোনো কাজে আসছে না। অভিযোগ স্থানীয় ঠিকাদাররা জরুরি কাজের ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী না হওয়ায় সময়মতো কাজ শুরু হয়নি। ঠিকাদারদের অভিযোগ, জরুরি (ইমার্জেন্সী ওয়ার্ক) কাজের ক্ষেত্রে ও পাউবো কমকর্তারা ১০ ভাগ পিসি (ঘুস) নেয় বলেই ঠিকাদাররা কাজ করতে চান না। আর তাই বাধ্য হয়েই নির্বাহী প্রকৌশলী নিজেই চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জিও ব্যাগ ফেলার উদ্যোগ নেন।এ সকল বিষয়ে জানার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জুলফিকার আলীর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি প্রথমবার ‘সাইটে আছি, পরে কথা বলব’ বলে এড়িয়ে যান, পরে ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।