নিউজ ডেস্ক
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল এবং ওভারটেকিংয়ের মত অ”সুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওভারটেকিং নামক অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং ফিটসেসবিহীন গাড়ি সড়কে চালানো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি অহেতুক নিয়মের বাইরে গিয়ে গাড়ি বা ট্রাকের আকার পরিবর্তন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ট্রাফিক পুলিশকেও এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীর খামারবাড়িস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০১৯’ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ড্রাইভারদেরও দোষ রয়েছে, কোন গাড়ি তাদের ওভারটেক করলে যেন মাথা খা’রাপ হয়ে যায়, ঐ গাড়িকে তাদেরও ওভার টেক করতেই হবে। ফলে, দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।’ তিনি বলেন, একটি রাস্তা কেমন লোড নিতে পারে, একটি সড়কে কি ধরনের দু’টি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে তার একটি আকার নির্দিষ্ট করা থাকে। অথচ, আমাদের দেশে দেখা যায় অধিক মুনাফার আশায় আসন বৃদ্ধির জন্য বা অতিরিক্ত মালামাল পরিবহনের জন্য ক্ষেত্রে বিশেষে এক্সট্রা ক্লাম দিয়ে দু’পাশে বে’আইনীভাবে গাড়ির আকার বাড়িয়ে নিচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।’
অতীতে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তৈরি করা এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত হলেও পরবর্তীতে তা থেমে যাওয়ার আবার তা শুরু হয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু পরিবর্তন এবং নতুন ঋতু আগমনের সঙ্গে সঙ্গে অতীতের বিষয়গুলো ভুলে যাওয়ার মত বৈশিষ্ট্য আমাদের মানসিকতায় রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। বিষয়টি সড়ক আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী বা আন্দোল’নকারীদের দৃষ্টিতে কেন আসেনি সে প্রশ্নও উত্থাপন করেন তিনি।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নির্বাহী সভাপতি শাজাহান খান এমপি, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান একাব্বর হোসেন এমপি, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এবং সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দোকার এনায়েত উল্লাহ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম স্বাগত বক্তৃতা করেন।
সড়কে যানবাহন এবং পথচারিদের চলাচলের ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর থেকে এই দিনটি সারাদেশে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শোভাযাত্রা, পোস্টার ও হ্যান্ডবিল বিতরণ, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ভিডিও চিত্র প্রদর্শন এবং আলোচনা সভাসহ নানামুখি কর্মসূচির মধ্যদিয়ে দিবসটি উদযাপন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘জীবনের আগে জীবিকা নয়, সড়ক দুর্ঘটনা আর নয়।’
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে তাঁর সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে গেলে সব থেকে বেশি যেটার প্রয়োজন সেটা হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের মানুষের একটা প্রবনতা হচ্ছে দুর্ঘটনা ঘটলে চালককে সবথেকে বেশি গালমন্দ করা। তিনি চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তাদের ক্রু’টি-বি’চ্যুতি ঘটার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েই বলেন, ‘দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কিন্তু কেবল চালক নয় পথচারিরাও অনেকাংশে দায়ী। কারণ, ফুটওভার ব্রীজ, আন্ডারপাস, ওভার পাস থাকার পরেও দেখা যায় যে পথচারিরা রাস্তার মাঝ খান দিয়ে পারাপার হচ্ছে, ফুটপাত ব্যবহার করছে না। একটি চলন্ত গাড়িকে কেবল হাত দেখিয়ে দৌড় দিয়ে বা মোবাইলে কথা বলতে বলতেই তারা রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গড়িটাতো একটা যন্ত্র। কাজেই ব্রেক করলেওতো থামতে এর কিছুটা সময় লাগে। কাজেই এই বোধটা বা জ্ঞানতো তাদের থাকতে হবে। সেইসাথে সড়ক চলাচলের যে আইন রয়েছে তাওতো মেনে চলতে হয়। এসব বিষয়ে সচেতনাও সৃষ্টি করা হয় না।’
তিনি দেশের স্কুল পর্যায়ে ট্রাফিক আইন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সরকার প্রধান বলেন, ‘এজন্য স্কুল-কলেজ এবং যেসব প্রতিষ্ঠানে অধিক জনবল কাজ করে তাদের মাঝে ট্রাফিক আইন বা ট্রাফিক রুল বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়াটা একান্তভাবে প্রয়োজন।’
গাড়ি চালকের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রামের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চালকরাও মানুষ তাদের যে বিশ্রাম বা আহারের প্রয়োজন রয়েছেন সে বিষয়ে সকলে নজর দেন কি না সন্দেহ, অনেকেই এ নিয়ে ভাবেন না। কাজেই, একজন চালক দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালাতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই একটু ঝিমুনি আসতে পারে আর তখনই দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, ‘দূরপাল্লার গাড়ির চালকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বিকল্প চালক না থাকায় অনেককেই অদক্ষ হেলপারের হাতে গাড়ি ছেড়ে দেয় এবং দুর্ঘটনা ঘটে।’ চালকদের জন্য সরকার উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ গ্রাম থেকে এসেই গাড়ি বা ভ্যান নিয়ে রাস্তায় নামতে পারবে না, তাদের এজন্য প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার এসডিজি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৭-২০২০’ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
তিনি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তাঁর সরকার আরোপিত বিভন্ন বিধি নিষেধ কার্যকরের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানান।
যেমন- কোন চালক টানা পাঁচ ঘন্টার বেশি কোন গাড়ি চালাতে পারবে না, অবশ্যই তাকে বিশ্রাম নিতে হবে। দুরপাল্লার যানবাহনে বিকল্প চালকের ব্যবস্থা রাখতে হবে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে, গাড়ির অ’নিয়ন্ত্রিত গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং ওভারটেকিং এর মত অ’সুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে।
এছাড়া, গাড়ি চালানো অবস্থায় এবং পথচারিদের রাস্তা পারাপার এমনকি রেলপথ ধরে হাঁটার সময়ও সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ করা, ফুটপাতকে দখল মুক্ত করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করা (সেজন্য ট্রাফিক পুলিশ জরিমানা হিসেবে টোল প্রথা চালু করতে পারে), বিভিন্ন শপিং মল এবং মার্কেটে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা, মহাসড়কগুলোতে নির্দিষ্ট দূরত্বে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার তৈরী প্রভৃতির দিকে নজর দিতে হবে।
তিনি চালক এবং যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার এবং রিফ্রেসমেন্ট সেন্টার তৈরীতে বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তাঁর সরকার পেশাদার এক লাখ দক্ষ গাড়ি চালক তৈরীর জন্য কাজ করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, একই সঙ্গে ৩ লাখ দক্ষ গাড়ি চালক তৈরীর জন্য নতুন একটা প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন জেলায় ভেহিক্যাল ইন্সপেকশন সেন্টার এবং ড্রাইভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি এ সময় স্কুল পর্যায়ে ট্রাফিক আইন প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কেন ট্রাফিক আইন মানবে না, প্রশ্নটি উত্থাপনকরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু কারও কাম্য নয়, কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করুক সেটাও কাম্য হতে পারে না, কত মানুষের জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেজন্যই আমরা চাই সব সময় একটা নিরপদ সড়ক ব্যবস্থা থাকুক, দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকুক।
দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই সকলে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। কারণ, দেশটা আমাদের, একটা মানুষের ক্ষতি হলে সে যেই হোক এদেশের কোন না কোন পরিবারেরইতো সে। কাজেই, সেই পরিবারের ভবিষ্যতটা কি হবে, সেটাওতো চিন্তা করতে হবে।’
নিরাপদ সড়কের জন্য তাঁর সরকার ‘সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮’ প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আইনটিকে দ্রুত কার্যকর করারও আহবান জানান এবং বলেন, ‘আমরা মহাসড়কগুলো চারলেনে রূপান্তর, বিপজ্জনক বাঁকগুলো মেরামতসহ বিভিন্ন সড়কের উন্নয়ন করছি। ফলে, দুর্ঘটনা কমে এসেছে। জনগণ আরো সচেতন হলে তা একেবারেই কমে আসবে।’ সূত্রঃ বাসস, ছবিঃ ইয়াসিন কবির জয়