এম. মনসুর আলী
গত ১ নভেম্বর ছিল প্রিয় ও নন্দিত লেখকের জন্মদিন। তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অদম্য চেষ্টা করেন। প্রচন্ড আশাবাদী একজন মানুষ তিনি। বলছিলাম লেখক সাদত আল মাহমুদের কথা। তিনি ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর টাংগাইল জেলার গোপালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মো.আব্দুর রাজ্জাক। ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি মেঝো। স্ত্রী ও কন্যা সায়মা মাহমুদকে নিয়ে ঢাকায় তাঁর পারিবারিক আবহ। সাদত আল মাহমুদ লেখালিখি শুরু করেন ১৬ বছর বয়স থেকেই। তখন নবম কি দশম শ্রেনিতে পড়েন। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতো। ১৮ বছর বয়সে তিনি “শেষ বেলায়” নামক প্রথম উপন্যাস লিখেন যা প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে।
সাদত আল মাহমুদ শুধু ঔপন্যাসিকই নন পাশাপাশি নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিকও বটে। তিনি উচিতবাদী, চরম কৃতজ্ঞ, সাদামাটা সহজ-সরল চির সবুজ মনের মানুষ। আমার সুমতির ৩০ বছর জীবনেও তাঁর মতো নিরহংকার, নম্র, ভদ্র, সুমেজাজী কোন লেখকের সাক্ষাৎ পাইনি। লেখক হিসেবে সাদত আল মাহমুদ এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির মধ্যবিত্ত জীবন ছবির নিপুণ কারিগরের ভুমিকা।
দেশপ্রেম ও মুক্তিযু’দ্ধের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ লেখক সাদত আল মাহমুদের আজ ৪৪ তম জন্মদিন। তিনি প্রায় ২ দশক ধরে নিরবি’চ্ছি’ন্নভাবে লিখে যাচ্ছেন। মধ্যবিত্তের ছোট ছোট সুখ আর বড় বড় দুঃখকে পরম আদরে সাহিত্য বানিয়েছেন তিনি। আর সেইসব আদরমাখা লেখা পড়ে এই প্রজন্মের অনেকের চোখে জল ঝরেছে। সমাজের বড় বড় অ’সংগতি খুব সূক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কথাসাহিত্যে।
“চি’তার আ’গুনে” উপন্যাসটি সাদত আল মাহমুদের প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। নিয়মিত উপন্যাস লেখা তাঁর অদম্য ইচ্ছা। উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটগল্প, রম্যরচনা, প্রবন্ধ ও ভৌতিক গল্প লিখেন। প্রাঞ্জল ভাষা, স্বছ বিচার-বিশ্লেষণ আর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তি লেখাকে কী পরিমাণে শাণিত করে তোলে সাদত আল মাহমুদের উপন্যাস পড়লেই বুঝবেন।
তাঁর উদ্দেশ্য সমাজের অসংগতি ও সমস্যাগুলো তাঁর উপন্যাস ও গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তুলে ধরা যাতে পাঠক এই সমস্যাগুলো পড়ে সাহিত্যরসের মাধ্যমে মনে ধারণ করে সমস্যাগুলো সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। তিনি দৈনিক সমকাল,জনকণ্ঠ, মুক্তকণ্ঠ, খোলা কাগজ, বাংলাদেশের খবর, সকালের খবর, প্রতিদিনের সংবাদ, ইনকিলাবসহ দেশের প্রধান প্রধান পত্রিকায় বিভিন্ন সম্মানজনক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক দেশ রূপান্তরের জি.এম সেলস হিসেবে কর্মরত আছেন।
সাদত আল মাহমুদ ১৯৯৭ এর দিকে নাটক লেখার কাজ শুরু করেন এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নাটক রচনা করেছেন তিনি। তিনি বাংলাদেশ বেতারে দীর্ঘদিন নাট্যকার হিসেবে কাজ করেছেন। এই আল্ট্রামর্ডান যুগে মানুষ এখন আর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনা। এক ভদ্রলোক (আমার কাছে অভদ্র) সেদিন বলেই ফেললেন, “কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলে নাকি ইজ্জতের ক্ষতি হয়”। এ ব্যাপারে সাদত আল মাহমুদ সম্পূর্ণ ভিন্ন।কেউ যদি তাঁর সামান্যতম উপকারও করে তিনি মাসে মাসে, চান্দে চান্দে উপকারীর উপকার স্বীকার করেন। জনসম্মুখে উপকারীর প্রসংশা করেন।
বইয়ের পাঠকদের বেলায়ও সাদত আল মাহমুদ বেশ সাবলীল ও সচেতন। তার লেখা ভিন্ন ধর্মী উপন্যাসের মধ্যে- বেশ সমাদৃত হয়েছে মুক্তিযু’দ্ধের কাহিনী নিয়ে লিখেছেন “রাজাকার কন্যা”। এছাড়াও কল্প কাহিনী নিয়ে শিশুদের জন্য লিখেছেন “ভূত ধরার অভিযান” ও “গগেনদার গল্পের ঝুড়ি”। সমকালীন উপন্যাসের মধ্যে চিতার আগুনে, রমণীদ্বয়, প্রসব বেদনা ও শেষ বেলায় উল্লেখযোগ্য।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ৩০ লক্ষ প্রাণের এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ই’জ্জত হরণের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জে’ল খেটেছেন। দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা আজ যে স্বাধীনতা ভোগ করছি, দেশটা কিভাবে পেলাম তার সঠিক ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে হবে। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য আমি “রাজা’কার কন্যা” বইটি লিখেছি।
নতুন লেখক সম্পর্কে তিনি বলেন, নতুনদের সুযোগ দিতে হবে। সক্রেটিসর,শেক্সপিয়ার, বার্ণা’শ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, হুমায়ুন আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের পূনর্জম্ম হবে না। যদি নতুন লেখকের জন্ম না হয় তাহলে বাংলা সাহিত্য দন্যদশায় পড়ে যাবে। নিজের লেখালেখি সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি নিজেকে লেখক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বা”ছন্দ্যবোধ করি। আমি যদি লেখক রয়েলিটি দিয়ে কোন রকমেও সংসার চালাতে পারি তাহলে চাকুরী একেবারে ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখালিখিতে মনোনিবেশ করবো। লেখালেখি আমার র’ক্ত কণিকার সাথে মিশে গেছে, তাই এটাকে আমি ছাড়তে পারবো না।
তিনি সারাদিন যা দেখতেন রাতে তা উজ্জ্বল আলোর মতো চোখদ্বয়ে খেলা করতো। নদীর ঢেউ,বাতাসের সাথে পাকা ধানের খেলা, নির্জন দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাক, দল বেঁধে পাখির উড়ে যাওয়া, ছোটদের ঘুড়ি উড়ানো এই সব দেখে তিনি খুব মুগ্ধ হতেন। পরবর্তীতে তিনি এ সব নিয়ে কল্পনার সাগরে ভাসতেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎবাবু সুনীল, সমরেশ, হুমায়ুনের লেখা লেখককে প্রভাবিত করতো। এভাবেই লেখার নেশা তাঁকে চেপে ধরে। এই ভাবেই লেখালেখির জগতে তাঁর আগমন ঘটে। তিনি জীবনে বই পড়েছেন খুবই কম। তাঁর লেখক হওয়ার পেছনের কারিগর তাঁর মা। মায়ের উৎসাহেই তিনি আজ কালজয়ী সাতটি বইয়ের জনক।
বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র লেখক যিনি আবা’ল-বৃদ্ধা-বনিতা সবার মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য দুই বছরে দুই লক্ষ টাকার উপরে বই বিতরণ করেছেন। অন্য কোন লেখক নিজের টাকায় এই কাজটি করেছেন বলে আমার জানা নেই। শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক। আপনার জন্মদিনের সব ফুল-আনন্দ-হাসি শুধু আপনার জন্য। আমাদের পক্ষ থেকে সব ভালোবাসা-শ্রদ্ধা ও শুভকামনা আপনার জন্য। সুস্থথাকুন, দীর্ঘজীবী হোন।