মীর আব্দুল গণি
জাতি গঠনে শিক্ষার যেমন কোনই বিকল্প নাই। তেমনি শিক্ষাদানেও রয়েছে বেশ কিছু প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ারও কোনই বিকল্প নাই। শিক্ষাদ্বারা আদর্শ ব্যক্তি ও জাতি গঠনের কাঙ্ক্ষিত বা প্রত্যাশিত প্রাপ্তি যদি না ঘটে তবে বুঝতে হবে অবশ্যই প্রক্রিয়ায় কোথাও কোন অ’পূর্ণতা বা ত্রু’টি রয়েছে।
প্রশ্ন হলো সেই অ’পূর্ণতা বা ত্রু’টি জানা ও দূর করার উপায় কি? সহজ উপায় হলো প্রচলিত শিক্ষাদানব্যবস্থাকে ধর্য্যসহ বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করা। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান-বৈশিষ্ট্য অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে এবং নিলে স্পষ্ট দেখা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হলো মূলতঃ লিখতে ও পড়তে শিখা বা শুধুই পাঠদানমূলক।
লিখতে ও পড়তে শিখাই পরিপূর্ণ শিক্ষা এমন ধারণামূলক শিক্ষাদানব্যবস্থার কারণে- শিক্ষার মূল বিষয়সমূহ যেমন- মানবিক, নৈতিক বা ব্যক্তির আচরণজাতগুণসমূহ ও ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়সমূহ শিক্ষাদান- প্রক্রিয়ার বাইরেই রয়ে যায়। ফলে ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠাণিক শিক্ষা লাভ করলেও মানবিক ও নৈতিকমূল্যবোধসম্পন্ন আচরণে আচরণশীল হতে সক্ষম হন না। (কেউ হলে সে ব্যতিক্রম।)
শিক্ষাকে কেন জাতির মেরুদ’ন্ড বলা হয়? জাতির মেরুদ’ন্ডের বৈশিষ্ট্য কী? ব্যক্তির শিক্ষার মৌলিক বিষয় কি? (শ্রদ্ধেয় কয়েকজন শিক্ষকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম। শিক্ষাবিজ্ঞানে যথাযত প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কারণেই কেউ সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন নাই। শিক্ষাদানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের কোনই বিকল্প নাই। বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন হতে বাধ্যতামূলক শিক্ষা শ্রেণীপর্যায় পর্যন্ত।)
আমাদের বুঝতে হবে শিক্ষাদান মূলতঃ ব্যক্তি সত্তায় মানসিক গঠণদানমূলক জ’টিল প্রক্রিয়া নির্ভর একটি কাজ। প্রতিটি কাজেরই যেমন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি, কিছু উপকরণ ও উপাদান থাকে। শিক্ষাদানকর্মেরও রয়েছে বিশেষ প্রক্রিয়া, বেশকিছু উপকরণ ও উপাদান যাহা শিক্ষককে জানতে হয় এবং তার গুণগত ও পরিমাণগতমাণ শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করতে হয়। সে জন্য শিক্ষককেও যথাযত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হতে হয়।
এখন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় শিক্ষাদানকর্মের উপাদানসমূহ কি কি? শিক্ষাদান কর্মের বৈশিষ্ট্যনুসারে আমরা নিম্নোল্লেখিত উপাদানসমূহ দেখতে পাই। যেমন- ক)শিক্ষাদান সময়, খ)শিক্ষার্থী, গ)শিক্ষক, ঘ) শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য, ঙ) শিক্ষার বিষয়, চ) শিক্ষাদান পদ্ধতি,…ইত্যাদি। এখন আমরা উপাদানসমূহের বৈশিষ্ট্যনুসারে শিক্ষাদানকর্ম-সম্পাদনের প্রক্রিয়ায় সমন্বয় পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
উপাদান- ক) শিক্ষাদান সময়-
শিক্ষাদান সময় বলতে আমরা শিক্ষা শুরুর বয়স ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার-শ্রেণীপর্যায় বুঝাবো। ব্যক্তি বা প্রা’ণীসত্তাকে অবশ্যই বিশেষ বয়সে শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
উপাদান- খ) শিক্ষার্থী- উন্নত দেশে তিনবছর বয়সেই শিশুদের কিন্ডারগার্টেন বাধ্যতামূক করা হয়ে থাকে এবং ৬ বৎসর বয়স পর্যন্ত বিশেষ প্রক্রিয়ায় মানসিক গঠণদান করা হয়। ঐ সময়ে তাদেরকে কোনরূপ অক্ষরজ্ঞান দেয়া হয় না। মৌলিক শিক্ষার অনেক বিষয় রয়েছে যাহা শিক্ষার্থীর বিশেষ বয়স হতেই ক্রমান্বয়ে শিক্ষা দিতে হয়। মনে করি শুরু ৩বছর বয়স হতে এবং শেষ ১০ম শ্রেণী।
উপাদান- গ) শিক্ষক- শিক্ষককে অবশ্যই আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে যথাযত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হতে হয়। বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন হতে বাধ্যতামূলক শ্রেণী পর্যায় পর্যন্ত যাঁরা শিক্ষাদানের দায়িত্বে থাকবেন।
উপাদান- ঘ) শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য- শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিকে কাঙ্ক্ষিত আচরণ-সক্ষম ও কোন বিষয়ে কাঙ্খিত মানসম্পন্ন সম্পাদন-সক্ষম করে তোলা। উপাদান- ঙ) শিক্ষার বিষয়- শিক্ষিত ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশিত আচরণশীলতার বৈশিষ্ট্যনুসারে- শিক্ষার বিষয়সমূহ আমরা নিম্নরূপে দুইভাগে ভাগ করতে পারি।
ঙ১- যেমন ১-লিখতে শিখা, ২-পড়তে শিখা। ঙ২- যেমন বিষয়ভিত্তিক বা কোন বস্তুগত বিষয়ে সম্পাদন সক্ষমতার্জন ও সত্তার মানসিক গঠনদানমূলক। যাহা বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষ বয়সে সত্তার মানসপটে জাগ্রত করে তুলতে হয়। যেমন- ১ মানবিকতা, ২ নীতিনৈতিকতা, ৩ সততা, ৪ নিষ্ঠা,…ইত্যাদি। আমাদের আলোচনায় উপমাতে- শিক্ষার উক্ত বিষয়সমূহ পরবর্তীতে শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করতে সংক্ষেপে শুধু তার ক্রমিক সংখ্যা যেমন- ঙ১- ১,২ ও ঙ২- ১, ২, ৩ ও ৪….ইত্যাদি উল্লেখ করবো।
উপাদান- চ) শিক্ষাদান পদ্ধতি- শিক্ষাদান মূলতঃ একটি কর্ম বা কাজ। প্রতিটি কর্ম বা কাজ সম্পাদনের একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি থাকে। যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি দ্বারা কাজটির উপাদানসমূহের পরিমাণগত ও গুণগতমাণ নিশ্চিত করা হয়।
শিক্ষাদান যেহেতু একটি কর্ম বা কাজ সেই হেতু শিক্ষাদানকর্মের উল্লেখিত (ক, খ, গ, ঘ, ঙ, ঙ১ ও ঙ২) উপাদানসমূহ পর্যায়ক্রমে যথাযত সমন্বয় সাধন করে সত্তাকে ইপ্সিত আচরণসক্ষম করে তোলার প্রক্রিয়াই হলো শিক্ষাদান পদ্ধতি।
শিক্ষার উপাদানসমূহ শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করার উপমাস্বরূপ আমরা একটি সরল রেখা ভিত্তিক ছক নিম্নে উপস্থাপন করতে পারি। মনে করি বেবী শ্রেণী শুরু A হতে এবং শেষ ১০ম শ্রেণী B তে । A হতে B পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষাসময়। বাধ্যতামূলক ঐ শিক্ষাসময়কে আমরা মনে করি A_____B সরল রেখা। বাধ্যতামূলক হওয়াতে প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই A_____B শিক্ষাসময় রেখা অতিক্রম করতেই হবে। অথএব A_____B সরল রেখা।
যেমন ছক ১ক) A-> ঙ১-১, ২ ও ঙ২- ১, ২,৩ ও ৪ <-B সময়সীমায় ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয় ও আচরণের উপাদানসমূহ পর্যায়ক্রমে সমন্বয় করে শিক্ষাদানসম্পন্ন করলে দেখা যায় পরবর্তিতে প্রাতিষ্ঠাণিক শিক্ষায় একের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য থাকলেও সকলেই সমপর্যায়ের মূল্যবোধসম্পন্ন আচরণে আচরণশীল হবার শিক্ষা পেয়ে থাকেন।
উন্নত জাতির শিক্ষাব্যবস্থা উক্তরূপ প্রক্রিয়াভুক্ত হওয়াতে তাদের প্রাতাষ্ঠানিক শিক্ষার পার্থক্য থাকলেও নাগরিক আচরণ সমপর্যায়ের মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে থাকে। এ পর্যায়ে আমাদের আলোচ্য শিক্ষাদানপদ্ধতি ছক ১ক এ যেহেতু ব্যক্তিকে কাঙ্ক্ষিত আচরণ-সক্ষম ও কোন বিষয়ে কাঙ্খিত মানসম্পন্ন সম্পাদন-সক্ষম করে তোলার শিক্ষাদানের নিশ্চয়তা পাই সেই হেতু
ছক ১ক) A-> ঙ১-১,২ ও ঙ২- ১, ২, ৩, ৪ <-B কে আদর্শ-শিক্ষাদানপদ্ধতি বলে উল্লেখ করবো।
আমাদের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতির অ’পূর্ণতা বা ত্রু’টিসমূহ নিরুপণ করা। অতএব বিস্তারিত আলোচনার অবতারনা না করে বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাদানব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত শিক্ষার উপাদানসমূহ আমাদের আলোচ্য শিক্ষাদানপদ্ধতি ছক ১ক-এ সন্নিবেশন করলে অ’পূর্ণতা বা ত্রু’টিসমূহ সহজেই বুঝা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাদানব্যবস্থায় আমরা দেখতে পাই শিক্ষাদানের অন্তর্ভুক্ত উপাদান বা বিষয় হলো- শুধু ‘‘লিখতে ও পড়তে শিখা‘’- তথা পাঠদানমূলক হওয়াতে প্রাপ্ত উপাদানসমূহ হলো- ঙ১- ১,২। আলোচ্য প্রক্রিয়া ছকে সমন্বয় করলে A ঙ১- ১,২ B প্রক্রিয়া রেখাতে শিক্ষাদানকর্মের বিষয় বা উপাদান হিসাবে শুধুই ঙ১- ১,২ উপদান সমন্বিত দেখতে পাই। অর্থাৎ ঙ১- ১,২ যাহা লিখতে ও পড়তে শিখা উপাদানসমূহ।
অন্যান্য উপাদান তথা ঙ২-১,২,৩ ও ৪..ইত্যাদি উপাদানসমূহ শিক্ষাদান প্রক্রিয়া A_____B রেখায় দেখতে পাই না। অর্থাৎ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তির বাইরেই রয়ে গেছে। মূলতঃ যাহা প্রচলিত শিক্ষাদান ব্যবস্থার ১ম অ’পূর্ণতা বা ত্রু’টি।
আমরা জানি শিক্ষার শেষ নাই এবং শিক্ষার বিষয় সীমাহীণ হলেও (অতিব সত্য সীমাহীন বিষয়ে সীমাহীণ শিক্ষা যেমন সবার প্রয়োজনও নাই এবং সবাই শিখতে সক্ষমও নয়। যেমন-ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ইত্যাদি।) কিন্তু ব্যক্তি-জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য এবং নাগরিক জীবনের কাঙ্ক্ষিত আচরণ সক্ষমতা অর্জণের জন্য প্রতিটি ব্যক্তিরই বেশ কিছু বিষয়ে শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন রয়েছে।
যে বিষয়সমূহের শিক্ষাকে বলা হয় ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষা। যেমন-(i) যে বিষয়সমূহের শিক্ষা ব্যক্তির দৈনন্দিনজীবনে চলার পথে অস্তিত্বের নিশ্চিয়তা নিশ্চিত করে। (যে বিষয়সমূহ না শিখলে ব্যক্তির অস্তিত্বের নিশ্চয়তা নিশ্চিত হয় না। সে সকল বিষয়সমূহ ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়রূপে অবশ্যই গুরুত্ব বহণ করে।) যেমন- ব্যক্তিজীবনের নিশ্চয়তার জন্য প্রত্যেককেই সাঁতার জানা, রাস্তাচলার নিয়মকানুন বা ট্রাফিক আইন জানা একান্ত প্রয়োজন।
(ii) যে বিষয়সমূহের শিক্ষা ব্যক্তিকে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন আচরণে আচরণশীল করে তোলে। যেমন- আমাদের পূর্বালোচ্য ঙ২- ১ মানবিকতা, ২ নীতিনৈতিকতা, ৩ সততা, ৪ নিষ্ঠা,…ইত্যাদি। অর্থাৎ (i) ও (ii) ক্ষেত্রদ্বয়ে মৌলিক বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যাহা প্রতিটি ব্যক্তিরই শিখা একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষার কাঙ্খিত লক্ষ্যার্জণ করতে হলে উক্তরূপ বিষয়সমূহ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রতিটি ব্যক্তিকে অবশ্যই শিক্ষাদান করতে হয়। যার কোনই বিকল্প নাই। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতি লক্ষ্য করলে স্প’ট দেখা যায়- ব্যক্তির মৌলিকশিক্ষার বিষয়সমূহ শিক্ষদানে কোনরূপ গুরুত্বই দেয়া হয় না যাহা ২য় অ’পূর্ণতা বা ত্রু’টি।
এখন প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে ব্যক্তির মৌলিকশিক্ষার বিষয়সমূহ শিক্ষাদানের দায়িত্ব কার? শিক্ষাদানের দায়িত্ব কার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিষয়ের বৈশিষ্ট্যগত দিক বিবেচনায় নিলে সহজেই উত্তর পাওয়া যায়। কারণ প্রতিটি বিষয়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যই ইঙ্গিত করে শিক্ষাদানের দায়ীত্ব কার।
যেমন- ট্রাফিক আইন ও সাঁতার শেখা বিষয় দুটির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলে দেখা যায়- ট্রাফিক আইন হলো বিশেষ সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত ও পরিচালিত নীতিগত ব্যবস্থা। ফলে শিক্ষাদানের দায়িত্ব যথাযথ কর্তৃপক্ষকেই নিতে হয়।
অপরদিকে- জীবন রক্ষার জন্য সাঁতার জানা বিশেষসংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত কোন নিয়মনীতি দ্বারা পরিচালিত হয় না। ফলে সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব অভিভাবককে দেয়া যায়। তবে প্রতিটি অভিভাবকই যে সাঁতারের গুরুত্ব অনুধাবণে সক্ষম নিশ্চিত হওয়া যায় না, সে জন্য শিক্ষাদান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অভিভাবকে তাগিদ দেয়া এবং শিখায়েছেন অবশ্যই জেনে নিশ্চিত হওয়া।
উন্নত দেশে উক্তরূপই করে থাকে। পুনরায় প্রশ্ন জাগে-যে বিষয়সমূহের শিক্ষা ব্যক্তিকে মূল্যবোধসম্পন্ন আচরণে আচরণশীল করে তোলে সেই বিষয়সমূহ শিক্ষাদানের দায়িত্ব কার? উক্ত প্রশ্নে আমরা অনেকই বলে থাকি শিক্ষাদানের দায়িত্ব পরিবারের।
শিক্ষাদানে আমরা পরিবারের যোগ্যতা যাচাই করতে গিয়ে দেখতে পাবো সমাজ-রাষ্ট্রে পরিবারসমূহের অবস্থানগত বিভিন্ন স্তর, কাঠামো রয়েছে এবং সেই অনুসারে তাদের জীবন যাত্রার মাণভেদও রয়েছে। সে কারণে সকল পরিবার সমাজ-রাষ্ট্রের কাঙ্খিত মূল্যবোধ-এর পরিমিতিবোধ বুঝতে সক্ষম হবে এমন নিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে ব্যক্তিকে সমাজ-রাষ্ট্রের কাঙ্খিত মূল্যবোধসম্পন্ন আচরণশীল করে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষাদান-ব্যবস্থাকেই নিতে হয়।
কারণ ঐ পরিমিত মূল্যবোধসমূহই বৃহত সমাজ-রাষ্টীয়ব্যবস্থা গড়ে উঠার মূল ভিত্তি বা মেরুদ’ন্ড। সকল উন্নত দেশই বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান সময়ের মধ্যেই ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষা ও মূল্যবোধসম্পন্ন আচরণে আচরণশীল করে তোলার জন্য বিশেষ শিক্ষাদান-প্রক্রিয়া গ্রহণ করে থাকে।
শিক্ষাদান প্রক্রিয়া বা কৌশলসমূহই হলো আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান (Pedagogy) বা সাইন্স অফ টিচিং।
শিক্ষাবিজ্ঞান মূলতঃ মনসতাত্বিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক বেশ জ’টিল প্রক্রিয়া। উন্নত দেশে দেখা যায় যাঁরা শিক্ষকতা পেশা গ্রহণে ইচ্ছুক অধ্যায়ণের একটা পর্যায়ে শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে অবশ্যই তাঁদের পড়ালেখা করতে হয়।
শিক্ষাদান পদ্ধতি বা কৌশলের গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের জানতে ও বুঝতে হবে শিক্ষাদানের অর্থ কি? শিক্ষাদানের অর্থ অতি সহজে ও সংক্ষেপে বলা যায়- ‘‘প্রক্রিয়াজাত কৌশলে সত্তার স্বকীয়বোধের স্থলে কাঙ্ক্ষিত বোধের উন্মেষ সাধনই হলো শিক্ষাদান।
উপমা যেমন ১+১=? ও ২-২=? ব্যক্তি স্বেচ্ছায় যা বলবে সেটা তার স্বকীয় বোধ উৎসারিত। ঠিক হবে এমন নয়, না হলেও দোষের নয়। কিন্তু শিক্ষাদান হলো উক্ত ক্ষেত্রে- পদ্ধতিগত ভাবে ১+১=২, এবং ২-২=০ ব্যক্তির বোধকে জাগ্রত করে তোলা। অর্থাৎ শিক্ষাদানের অর্থ হলো সত্তার স্বকীয়বোধের স্থলে কাঙ্খিত বোধের জাগরণ ঘটানো।
এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াজাত কৌশল এবং তার গুরুত্ব বিস্তারিত তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমার লেখা ‘‘গঠনমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বইটিতে শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যার্জণ তথা আদর্শ জাতিগঠণ করতে হলে লিখতে ও পড়তে শিখা পরিপূর্ণশিক্ষা এরূপ ধারণা নির্ভর শিক্ষাদানব্যবস্থা পরিহার করে অবশ্যই আধুনিক শিক্ষাদানপদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে যাঁদের স্পষ্ট ধারণা আছে তাঁদের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। যার কোনই বিকল্প নাই।
উপসংহারে উল্লেখ করবো ইউরোপ আমেরিকা ও অন্যান্য অনেক উন্নত দেশে আমাদের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য যান কিন্তু শিক্ষার ঐ পর্যায়ের বহু পূর্বেই মৌলিক শিক্ষাদান শেষ হয়ে থাকে। ফলে তাঁদের মৌলিকশিক্ষাদানের প্রক্রিয়া আমাদের মেধাবীগণ কখনই অবগত হতে সক্ষম হন না।
মীর আব্দুল গণি
জার্মানি প্রবাসী
e mail: [email protected]