মীর আব্দুল গণি, জার্মানি প্রবাসী
আমরা আলোচনায় পূর্বেই অবগত হয়েছি এবং উল্লেখ করেছি ব্যক্তি আচরণের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসমূহই হলো জাতির মেরুদণ্ড। অতএব উক্ত প্রশ্নটির সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো- শিক্ষাদানের যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি ব্যক্তি সমষ্টিতে ’’মানবিক ও নৈতিক মূল্য-বোধসম্পন্ন আচরণশীলতার উন্মেষ সাধন করে ব্যক্তি সমষ্টিকে রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত আচরণ সক্ষম করে তোলে’’সেই প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিই হলো জাতির মেরুদণ্ড গঠনের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া।
এ পর্যায়ে একটি প্রশ্ন রেখে পরিবর্তী প্রসঙ্গে আলোচনা করব- উপরিউক্ত আলোচনাসমূহে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তসমূহে উপনিত হতে যেসকল যৌক্তিক ভিত্তি উপস্থাপন করা হয়েছে তার বিকল্প আছে কি?
৭. শিক্ষার্থীর সত্তাগত সক্ষমতাঃ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সত্তাগত সক্ষমতা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ মানসিক ও দৈহিক কারণে অনেক বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের সক্ষমতা অনেকের নাও থাকতে পারে।
৮. শিক্ষার্থীর বয়স নির্বাচনঃ শিক্ষা শুরুর বয়সের ধারণা- শিক্ষাদান একটি বিশেষ বয়সে শুরু করতে হয় এমন ধারণা কি শুধু আমাদের, না কি অতীতে ও বর্তমানে এমন ধারণা পোষণ করা হয়। এখন সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। (জানার কারণ হলো- বিশ্বে প্রতিটি জাতি রাষ্ট্রে অনেক সমস্যা আছে যা সর্বত্র এক ও অভিন্ন এবং যার সমাধান প্রক্রিয়াও হয়ে থাকে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এক ও অভিন্ন। সমস্যা সমাধানে যারা কৃতকার্য হয়েছেন তাদের অনুসরণ করলে সমস্যা হতে সহজেই মুক্ত হওয়া সম্ভব।)
প্রথমে আমরা মনীষীদের কিছু বাণী নিয়ে আলোচনা করব। যেমন- প্লেটো রিপাবলিকে উল্লেখ করেছেন- “শিক্ষা মানুষের জীবনকে কীভাবে শুরু করে দেয় তার উপরই তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।” প্লেটো, রিপাবলিক, পৃ. ১৯০)
“যে কোন কাজের শুরুটাই হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যারা কচি তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে একথা অবশ্যই সত্য কচি বয়সেই চরিত্র গঠিত হয়; যা কিছু বাঞ্ছিত তার দাগ মনের উপর এই বয়সে সহজেই কেটে দেওয়া যায়।” (প্লেটো, রিপাবলিক, পৃ. ১১১)
“নগরীর সেই সব অধিবাসীদের নিয়ে যাদের বয়স দশ অতিক্রম করেনি। এই নিষ্কলঙ্ক শিশুদের শিক্ষিত করা হবে রাষ্ট্রের আদর্শ বিধি-বিধান এবং অভ্যাসে।” (প্লেটো, রিপাবলিক, পৃ. ৩৭২)
“ন্যায় এবং সম্মানের কতগুলি নীতি আছে। শৈশবে বিদ্যালয়ে এ-সকল নীতি আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়, এবং এই নীতির অভিভাবকত্বেই আমরা বর্ধিত হয়ে উঠি। এই সমস্ত নীতির আমরা বাধ্য থাকি এবং এদের সম্মান করি।” (প্লেটো, রিপাবলিক, পৃ. ৩৬৮)
“চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উত্তম শিক্ষার মাধ্যমে দৃঢ়মূল হয়ে ক্রমান্বয়ে অধিকতর উন্নত হয়ে উঠে।” (প্লেটো, রিপাবলিক, পৃ. ১৮৮) উপরিউক্ত বাণীসমূহেও দেখা যায় শিক্ষাদান শুরুর সময় নির্বাচনে সত্তার বিশেষ বয়সকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের আলোচনায়ও শিক্ষা শুরুর বয়স নির্বাচনকে শিক্ষাদান ব্যবস্থার
উপাদানসমূহের একটি উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ শিক্ষা হলো সত্তার বোধগত উপলব্ধির রূপান্তর সাধন। রূপান্তর সাধনে বয়স নির্বাচনের গুরুত্ব একটি দৃশ্যত উদাহরণের সাহায্যে তুলে ধরা যায়।
যেমন- বটবৃক্ষের বনসাঈ। আমরা জানি কোনো বৃহৎ বৃক্ষ কেটে-ছেঁটে বনসাঈ-এ রূপদান করা হয় না বা করা যায় না। বৃক্ষ চারার বিশেষ বয়স হতেপ্রক্রিয়াজাত করে কাঙ্ক্ষিত অবয়বে রূপান্তরিত করা হয়। বনসাঈ-এ প্রতীয়মান হয়, রূপান্তর হলো যথাসময়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে অবশ্যই বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে যে, শিক্ষা হলো সত্তার বোধ-চেতনার রূপান্তর বা পরিবর্তন সাধন। যেমন (শিক্ষা কি) সত্তার আচরণ সক্ষমতার বৈশিষ্ট্যে উল্লেখ করা হয়েছে- সত্তার স্বকীয় আচরণ সক্ষমতা ’ক’ ১ + ১ = ? ২ – ১ = ? … (অনাকাঙ্ক্ষিত)
সত্তার উন্মেষিত আচরণ সক্ষমতা ’খ’ ১ + ১ = ২ . ২ – ১ = ১ (কাঙ্ক্ষিত) মূলত ’খ’ আচরণ হলো সত্তার রূপান্তরিত আচরণ। বয়স নির্বাচন দুটি কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কারণ : শিক্ষার্থীকে শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী করে তোলার প্রক্রিয়াধীন করা। উপযোগী করে তুলার গুরুত্ব বুঝতে সহজ হবে যদি আমরা শিক্ষাদান শব্দটির অর্থ অনুধাবন করি। ‘শিক্ষাদান’ শব্দটি শিক্ষা দান-করা বা অর্পণ করা বুঝায়। দান বা অর্পণের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হয় যেটা দান করা হচ্ছে সেটা গ্রহণে গ্রহীতা সক্ষম কি না।
বাস্তবতা হলো গ্রহীতা সক্ষম নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। ফলে গ্রহীতাকে গ্রহণে সক্ষম করে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। শিক্ষার্থীর বয়স নির্বাচন মূলত শিক্ষা গ্রহণ উপযোগী করে তোলার প্রক্রিয়া গ্রহণের যথাযথ সময় নির্বাচন। শিক্ষার্থীকে উপযোগী করে তোলার গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য উপমা স্বরূপ উল্লেখ করা যায়। যেমন- প্রত্যাশিত ফসল পেতে জমিকে যথাসময়ে বপন বা রোপণের যথাযথ উপযোগী করে তোলা।
দ্বিতীয় কারণ : আমরা জানি, মানুষ জন্মগ্রহণ করে গুণহীন প্রাণীরূপে। এবং তার গুণাগুণের উৎস বোধ-চেতনা থাকে শূন্য পাত্র সমতুল্য। কিন্তু জন্মের পর হতেই তার ঐ শূন্য পাত্রটিতে পরিবার পারিবারিক বোধ- চেতনা উৎসারিত আচরণশীলতায় ভরে তুলতে থাকে। উক্ত কারণে শিক্ষাদানের শুরুর তেমন একটি বয়স স্তর নির্বাচন করতে হয় যে বয়স স্তরে পরিবারের উন্মেষিত বোধ-চেতনা নির্ভর আচরণ সত্তায় স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে না পারে বা যেটুকু প্রভাব রাখে তা সহজে পরিবর্তন বা অপসারণ করা সম্ভব।
কারণ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য যেহেতু প্রাণীসত্তার স্বকীয় বোধ-চেতনার পরিবর্তন সাধন সেই হেতু অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে- কোন বয়স স্তর হতে সত্তার স্বকীয় বোধ-চেতনার পরিবর্তন সাধন সহজ তেমন বয়স স্তরে শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াধীন করা। উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীর বয়স নির্বাচনের কারণ দুটিকে আমরা সংক্ষেপে উল্লেখ করতে পারি-
১ম, শিক্ষার্থীকে শিক্ষা গ্রহণ উপযোগী করে তোলার প্রক্রিয়াধীনে নিয়ে আসা। ২য়, তার বোধ-চেতনার উন্মেষে পারিবারিক আচরণের প্রভাব মুক্ত রাখা। (সূত্রঃ “গঠনমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা”) পূর্ব লেখাঃ
পরিবার বা প্রক্রিয়াহীণ ও প্রক্রিয়াজাত শিক্ষাদানব্যবস্থার লক্ষণীয় পার্থক্য ও গুরুত্ব