শিশুদের সাঁতার শিখানোর আবশ্যকতা

3
5
শিশুদের সাঁতার শিখানোর আবশ্যকতা
শিশুদের সাঁতার শিখানোর আবশ্যকতা

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান

‘সেন্টমার্টিন্সে সাগরে ডুবে দুই ছাত্রের মৃত্যু’, ‘কক্সবাজার সৈকতে ডুবে যুবকের মৃত্যু’, ‘রংপুরে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু’, ‘পানিতে ডুবে দুই বোনের মৃত্যু’, ‘পানিতে ডুবে ভাইবোনের মৃত্যু’- পত্রিকায় এমন হৃদয়বিদারক শিরোনাম আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। খবর শুনে পরিবারের আহাজারি, ময়নাতদন্ত, তারপর শেষ। কিন্তু যে পরিবারের সন্তানটি গেল সে পরিবারের অবস্থা কি আমরা কখনো উপলব্ধি করছি? পরিসংখ্যানটা এখন খুবই দরকার যে, শহরের শতকরা কতটি শিশু সাঁতার কাটতে শিখেছে? সাঁতার শিখানোর কতটা ব্যবস্থা শহরগুলোতে আছে? অথবা শিশুদের সাঁতার শিখানোর দায়িত্বইবা কোন বিভাগের?

পানিতে ডুবে মৃত্যুর কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পানিতে ডুবে মৃত্যু সংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। এরপরও ডুবে মৃত্যুর ৯১ শতাংশ ঘটে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। এ সংস্থার সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে ডুবে মৃত্যুতে বাংলাদেশ বিশ্বে ২২তম। প্রথম আফ্রিকার গায়ানা। বাংলাদেশ ছাড়া প্রথম ২২টির ১৯টিই আফ্রিকার দেশ। পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে জাতীয়ভাবে সর্বশেষ জরিপ হয়েছে ২০১৬ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় সেন্টার ফর ইনজুরিপ্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতিবছর সব বয়সি প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ আনুমানিক ১৪ হাজার ৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সি। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পলভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’-তে দেশে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, ৫ বছরের কম বয়সি ৪৪ শতাংশ শিশুরমৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এরপরই পানিতে ডুবে মৃত্যুর স্থান। এটি প্রায় ৯ শতাংশ। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর এ পরিসংখ্যান আর কত প্রলম্বিত হবে? আশঙ্কার বিষয় হলো এসডিজির লক্ষ্যমাত্রায় পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কোনো প্রতিকারের কথা বলা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল ২০১২-৩১-এ পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। আবার‘অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুখাত ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫’-এ ১০ দফা লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরা হয়েছে। তাতেও পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি। এ প্রশ্নটি খুব স্বাভাবিকভাবেই আসতে পারে যে, নদনদী, খালবিল, পুকুরডোবার বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক লোক নদীপথে যাতায়ত করে। প্রতিবছর এখানে বন্যায় দেশের বিশাল অংশ তলিয়ে যায়। তখন পানির সাথে যুদ্ধ করে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এক বা একাধিক পুকুর/ডোবা রয়েছে। এমন একটি দেশের সন্তানেরা সাঁতার কাটতে জানেনা বা জানবেনা- এটা কি করে সম্ভব? সাঁতার শিখানোর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আর এটা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নড়াইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ি জেলায়। তাছাড়া জানা গেছে যে, অন্যান্য জেলা সমূহের জন্য প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা বলেছে তাদের নির্দেশিকায়। এগুলোর মধ্যে পুকুর-ডোবায় বেড়া দেওয়া এবং স্কুলগামী শিশুদের সাঁতার শেখানোর কথা বলা আছে। মূলত: এ দুটি ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি গণ সচেতনতা তৈরি করা দরকার। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় দেশব্যাপী গণ সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে। গ্রামের শিশুরা নিজনিজ বাড়িতে থাকা পুকুরে অভিভাবকদের সহায়তায় সাঁতার শিখতে পারে। এক্ষেত্রে গ্রামের অভিভাবকদের সচেতন করে তুলতে হবে। গ্রামের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুকুর রয়েছে। সেগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করে সাঁতার শিখানোর ব্যবস্থা করা যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে পারে। একটা গাইড লাইন তৈরি করে দিতে পারে।

প্রকট সমস্যা হলো শহরের স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অথবা যারা স্কুলে যায়নি তাদের নিয়ে। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণ করে লোকবল নিয়োগ দিতে পারে। শহরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সাঁতার শিখানোর অবকাঠামো নির্মাণের জায়গা রয়েছে। এছাড়া সাধারণ জনগণের জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে সাঁতার শিখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ গ্রহণ। এ উদ্যোগে বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনকেও যুক্ত করা যায়।প্রতিটি বহুতল ভবনে সুইমিংপুল করার বাধ্যবাধকতা করা যেতে পারে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। এর পাশাপাশি প্রতিটি শহরে বিদ্যমান পুকুর/লেকগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করে সাঁতার শিখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বিভিন্ন শহরে কী পরিমাণ পুকুর/লেক আছে তার একটি সমীক্ষা প্রয়োজন। তার আলোকে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সে পুকুর/লেকগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করে সাঁতার ফেডারেশন ও কমিউনিটি পিপলের সমন্বয়ে কমিটি করে সাঁতার শিখানোর ব্যবস্থা করা যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী দিনগুলোতে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করবে সেখানে পুকুর রাখার বাধ্যবাধকতা করা অত্যাবশ্যক। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।প্রাথমিক বিদ্যালয় স্তরের তুলনায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্তরে সাঁতার শিখানোর উপযুক্ত বয়স বলে মনে করা হয়। এখন বর্ষাকাল চলছে। এ সময়ে নদীনালা, খালবিল, পুকুরডোবা পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। বন্যা হবে দেশের বিভিন্ন জেলায়। এ সময়ে শিশুদের সতর্ক নজরে রাখতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের সাঁতার শিখানোরও উপযুক্ত সময় এটি। তাই অভিভাবকরা সন্তানদের এ সময়ে সাঁতার শিখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। আপনাদের ব্যস্ততার মাঝেও শিশুদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কাজটি করতে হবে।

শিশুদের রক্ষায় সাঁতার শিখানোর আবশ্যকতা উপলব্ধি করে জাতিসংঘ ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা করেছে ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল। পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ কল্পে এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে- ‘যে কেউ পানিতে ডুবে যেতে পারি, সবাই মিলে প্রতিরোধ করি’। প্রতিরোধ সবাই মিলেই করতে হবে। কিন্তু নেতৃত্ব থাকতে হবে। শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মহিলা ও শিশু, যুব ও ক্রীড়া এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করলে আশা করা যায় পানিতে ডুবে মরার মত হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে আমরা নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারবো। সমুদ্র বা নদীরপাড়ে ঘুরতে গিয়ে কোনো শিক্ষার্থীর মৃত্যু হবেনা, কোনো মায়ের বুক খালি হবেনা, কোনো পরিবারের স্বপ্ন পানিতে তলিয়ে যাবেনা- এমন বাংলাদেশ আমাদের প্রত্যাশা। লেখক: পরিচালক, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর