লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ-১১ঃ শরণার্থীদের ভারত গমনের দৃশ্য আজো স্মৃতিপটে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে

0
9
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ- পুনরায় যশোর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে যে ঘটনাগুলি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হিসাবে আজো আমার স্মৃতিপটে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে শরণার্থীদের ভারত গমনের দৃশ্য। দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গেছে। বহনযোগ্য হালকা জিনিষপত্রসহ শুকনো কিছু খাবার পোটলা বেঁধে মাথায় এবং শিশু সন্তান কোলে নিয়ে সারিবদ্ধ হেঁটে যাবার সে দৃশ্য নিজ চোখে না দেখলে এখন তা বলে বা কাগজে লিখে বোঝানো যবে না। কেবলমাত্র নদী পারাপার ছাড়া পুরো পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। তাও আবার দুই-এক ঘন্টা বা দুই-একদিন নয়। গোপালগঞ্জ বা বরিশাল থেকে যারা শরণার্থী হয়ে ভারতে গেছে তাদের পৌছাতে ৬/৭ দিন লেগে গেছে। পায়ে হাঁটা পথটি নিরাপদ হলে অন্ততঃ নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁটা যায়। সেখানেও যে কোন সময় রাজাকার বা পুলিশের হামলা হতে পারে। এমনকি বড় দুর্ভাগ্য হলে পাক আর্মির সাক্ষাতও মিলে যেতে পারে। ফলে যে কোন সময় নির্ঘাত মৃত্যুর মত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকসেনারা ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর ও ছাত্রাবাস গুলিতে হামলা চালিয়ে নৃশংসতা চালালে শহরের অনেক মানুষ গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। শিক্ষিত চাকুরিজীবী লোক যারা সাধারণত গ্রামে আসতেন না মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে শহরে পাক আর্মির নৃশংসতা শুরু হলে তারাও জীবন বাঁচাতে গ্রামে আশ্রয় নেয়। কিন্তু এপ্রিল-মে মাসের দিকে পিস কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনের পর ওদের সহায়তায় পাকসেনারা গ্রামেও হামলা চালাতে শুরু করে।

এসময় বিভিন্ন থানায় থাকা পুলিশের একাংশ পাক সরকারের আনগত্য স্বীকার করে রাজাকারদের নিয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পাকসেনারা তাদের সহায়তায় বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। লোহাগড়া থানার পূর্ব সীমান্তবর্তী মধুমতি নদীর পাড়ে গোপালগঞ্জ মহাকুমার (বর্তমানে জেলা) ভাটিয়াপাড়ায় এমন একটি শক্তিশালী সেনা ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এই ক্যাম্প থেকে রাজাকার ও পুলিশের সহায়তায় পাকসেনারা গ্রামে গ্রামে ঢুকে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকসেনারা মুক্তিকামী বাঙালীদের ‘শায়েস্তা’ করতে রাজাকারদের নিয়ে প্রথম প্রথম আওয়ামীলীগ সমর্থকদের বাড়ি- বিশেষ করে হিন্দুদের বাড়ি চিহ্নিত করে পুড়িয়ে দিতে থাকে। গ্রামে ঢুকে ‘মালাউন কাহা এবং মুক্তিলোক কাহা’ বলে খুঁজতো। যুবকদের দেখলে মুক্তিলোক সন্দেহে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতো। মালাউন সন্দেহে ‘কাপরা উৎরাও’ বলে পরণের কাপড় খুলে দেখতো। ওরা মহিলাদের ধরে নিয়ে যৌন নির্যাতন করতো এবং পরে তাদের অধিকাংশদেরই হত্যা করতো। প্রথমদিকে হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করলেও পরবর্তীতে সব শ্রেণীর মানুষই ওদের নির্মমতার শিকার হয়। হিন্দু অধ্যুষিত গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও বৃহত্তর বরিশাল জেলার মানুষ বেশী নির্যাতনের শিকার হয়।

তাই সহায় সম্বল ভিটেমাটির মায়া ছেড়ে দলে দলে মানুষ শুধুমাত্র জীবন বাঁচাতে পরিবারের শিশু-বৃদ্ধ সবাইকে নিয়ে ভারতের পথে রওনা হয়। মে মাসের শেষ দিক থেকে শরণার্থীরা ভারত যেতে শুরু করে। এসময় ভারত সরকার সীমান্ত খুলে দেয়। দেশত্যাগী শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে এবং আশ্রিতদের খাবারের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন পশ্চিম বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অন্ততঃ ৫ শতাধিক শরণার্থী শিবির স্থাপন করে। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া লোক ছাড়াও অনেকে ভারতে বসবাসকারী আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছিল। দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিত। শরণার্থীদের সাথে একই ভাবে পায়ে হেঁটে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যুবকরা দলে দলে ভারতে যায়। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত শরণার্থীরা রাতে যেকোন স্কুল-কলেজে অথবা পথের পাশে কোন গৃহস্তের বাড়িতে আশ্রয় নিত। বিশেষ করে যুবতী কন্যা অথবা সুন্দরী গৃহবধুরা চলার পথে কোন মুসলমান বাড়িতে আশ্রয় নিত। আশ্রয়দাতা পরিবারটিও পরম মমতায় তাদের সাধ্যমত সাহায্য করতো। তারা মনে করতো আশ্রিতরা তাদের দীর্ঘদিনের পুরানো কোন আত্মীয়-স্বজন। আশ্রয়দাতার এ মানবিক আচরণের কথা অনেকেই সারা জীবন মনে রেখেছে। অনেকে দেশে ফিরে চিঠি লিখে অথবা দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

শরণার্থীদের পথচলার এ দৃশ্য আমার স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। পরিবারের অসুস্থ্য সদস্য অথবা অতিশয় বৃদ্ধ মা-বাবাকে বাঁশের ঝোলায় ভরে কাঁধে করে নিয়ে যেতে দেখেছি। সন্তান সম্ভবা মহিলাদের অনেকে চলার পথেই সন্তানের জন্ম দিয়েছে। নিজের জীবন বাঁচার যেখানে নিশ্চয়তা নেই সেখানে সদ্যজাত শিশুটিকে কিভাবে বাঁচাবে। তাই কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ফেলে দিয়ে গেছে নাড়ি ছেড়া ধন। আবার কেউ কেউ সন্তানটি অন্ততঃ বেঁচে থাকুক এই ভরসায় স্থানীয়দের কাছে দিয়ে গেছে সদ্য ভুমিষ্ট শিশুটিকে। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে দলে দলে মানুষের সীমান্তের দিকে সারিবদ্ধ চলার সে দৃশ্য আজো আমার স্মৃতি পটে ভেসে ওঠে।

ইতনা বাজার থেকে মধুমতি নদীর পাড় দিয়ে আতোষপাড়া পর্যন্ত অন্ততঃ তিন কিলোমিটার ফাঁকা নদীর চর দিয়ে পায়ে চলার রাস্তা। ইতনা বাজারে দাঁড়ালে পুরো রাস্তাটি নজরে আসে। প্রতিদিন শত শত শরণার্থী এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। একদিন আমি পাংখারচর থেকে ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। ওই রাস্তা দিয়ে শরণার্থীদের যেতে আগেও দেখেছি। কিন্তু ওই দিন যেন বিশেষ ভাবে দেখলাম। তিন কিলোমিটার চরের রাস্তায় শুধু সারিবদ্ধ মানুষ আর মানুষ। চলার পথে মানুষের সে যে কী নিদারুণ কষ্ট তা প্রখ্যাত মার্কিন কবি এলেন্স গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় মর্মান্তিক ভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানব দরদী এই কবি ভারতে এসেছিলেন প্রখ্যাত বাঙালী কবি সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের বাড়িতে। সেখান থেকে তিনি শরণার্থীদের দেখতে পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরেও গিয়েছিলেন। কবি বনগাঁয় কালিবাবু রোডে (যশোর থেকে ভারতের বনগাঁ পর্যন্ত রোড) এসে রাস্তায় শরণার্থীদের পথচলার দৃশ্য নিজ চোখে দেখে ফিরে গিয়ে এই বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন। পরে তিনি তাঁর এই কবিতাটি নিজেই সুর দিয়ে গান হিসাবে গেয়ে শোনান।

কবি তাঁর সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতায় লিখেছেন, ‘শত শত মুখ হায় একাত্তুর যশোর রোড যে কত কথা বলে / এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ববাংলা কোলকাতা চলে / লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে / লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায় / গৃহহীন ভাসে শত শত লোক / লক্ষ জননী পাগল প্রায় / রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু / পেট গুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে / এইটুকু শিশু, এতবড় চোখ / দিশে হারা মা কার কাছে ছোটে / সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর /ঘর ভেঙ্গে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে,যশোর রোডের দু’ধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেন মরে /……….ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে / যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি দেশ / মাথার ওপরে বোমারু বিমান / এই কাল রাত শেষ হবে কবে’।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু এই মার্কিন কবির ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় উঠে এসেছে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃত রূপ।
ভারত সরকার শরণার্থীদের যাবার জন্য সীমান্তের সব পথই খুলে দিয়েছিল। তবে বৃহত্তর বরিশাল জেলা, ফরিদপুর জেলার সদর ও গোপালগঞ্জ মহাকুমা (বর্তমানে জেলা) এবং বাগেরহাট জেলার শরণার্থীদের ভারতে যাওয়ার অন্যতম রুট ছিল লোহাগড়ার উপর দিয়ে। ওইসব অঞ্চলের শরণার্থীরা লোহাগড়া থানার পূর্ব সীমান্ত অর্থ্যাৎ মাঠলা ও ফুকরাঘাট দিয়ে মধুমতি নদী পার হয়ে ডিগ্রিরচর, চরদৌলতপুর, ইতনা, করফা, চরকরফা, কালনা, কামঠানা হয়ে আড়িয়ারার মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে যেয়ে ছত্রহাজারী হয়ে মাগুরা জেলার পুলুম-মধুখালি হয়ে কালিগঞ্জ রাস্তা পার হয়ে বরইচরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতো। দীর্ঘ যাত্রাপথই ছিল পুরো পায়ে হেঁটে। তবে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত কালনা কামঠানা আড়িয়ারার রুট ব্যবহার করা হলেও বর্ষাকালে মঙ্গলহাটার মধ্য দিয়ে কুন্দশী এসে নৌকা যোগে পুলুম মধুখালি যাবার আরেকটি একটি রুট চালু হয়। কুন্দশী গ্রামের ত্রিমোহনায় নবগঙ্গা নদীর ঘাটে বিভিন্ন ধরনের নৌকায় এসব শরণার্থীদের বহন করা হতো।

ফলে কুন্দশী ছিল ওইসব শরণার্থীদের সাময়িক যাত্রা বিরতি কেন্দ্র। আমার বাড়ি এই কুন্দশী গ্রামে হওয়ায় খুব কাছ থেকে শরণার্থীদের দুরাবস্থা দেখার সুযোগ হয়েছে। পথে পথে পাক আর্মি ছাড়াও ছিল রাজাকার ও তাদের অনুগত পুলিশ বাহিনি। এদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের প্রাণপণ হেঁটে যাবার যে কী কষ্ট তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই অনুভব করতে পারবেন না। নিজ চোখে দেখলে অন্ততঃ কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারেন। লেখা চলবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব )