এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান
স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকেই নড়াইল মহাকুমা বামপন্থী রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে বামপন্থীদের শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছিল। কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বামপন্থীরা একাধিকবার ছাত্রলীগকে হারিয়ে ছাত্র সংসদ দখলে নিয়েছে। ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নড়াইল ট্রেজারী ভেঙ্গে বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সংগ্রহকালেও বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। সংগৃহীত অ/স্ত্র-শ/স্ত্রের একটি বড় অংশ বামপন্থীরা তাদের দখলে নিয়ে যায়। এই বামপন্থী নেতারাই মুক্তিযুদ্ধকালে ‘নকশাল বাহিনী ’ নামে পরিচিতি পায়।
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি সংক্ষেপে ই পি সি পি (এম এল) নামের রাজনৈতিক সংগঠনটি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের মত করে লড়াই সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তারা ভারতের চারু মজুমদারের তাত্ত্বিক মতবাদ ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। ভারতের নকশাল নেতা চারু মজুমদারের ‘শ্রেণী শত্রু খতমের’ লাইন গ্রহন করায় বাংলাদেশেও তাদের অনুসারীরা ‘নকশাল ’ নামে পরিচিতি পায়।
এপ্রিল মাসের শুরুতে যশোর সেনানিবাসে পাক আর্মিদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধেও বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। এ সময় ইপিসিপি (এম এল) কর্মীরা যশোর কারাগার ভেঙ্গে তাদের নেতা কমরেড অমল সেন, তেভাগা আন্দোলনে সাজাপ্রাপ্ত নেতা রসিক লাল ঘোষ, এডঃ গোলাম মোস্তফা , খুলনার শ্রমিক নেতা আশরাফ হোসেন সহ কারাবন্দীদের বের করে আনেন। যশোর অবরোধে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে নড়াইল লোহাগড়ার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যখন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহনের উদ্দেশে ভারতে পাড়ি জমান তখন এই নকশাল বাহিনীই ছিল দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী ও তাদের দালাল পিস কমিটি এবং রাজাকার-আলবদরদের প্রতিরোধকারী একমাত্র বাহিনী।
যশোর সেনানিবাসের পাক সেনাদের অবরোধ যুদ্ধের সময়ে বিতরণকৃত অ/স্ত্রগুলি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর যার যার কাছেই রয়ে যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব অ/স্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এক শ্রেনীর দুর্বত্তরা চুরি ডাকাতিসহ নানাবিধ অপরাধজনক কাজে লিপ্ত হয়। তখন নকশালরা তাদের প্রতিরোধ করে এবং শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে। এপ্রিল মাসের দিকে চুরি ডাকাতির অপরাধে আবু নামে এক ব্যক্তিকে নকশালরা গ/লা কে/টে হ/ত্যা করে। লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পূর্বদিকে পাটের জমিতে আবুর মস্তক বিহীন গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। যা দেখে অপরাধীদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভীতির সঞ্চার হয়। তখন দুর্বৃত্তদের কেউ কেউ চুরি ডাকাতি বা লুঠ করা মালামাল স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে আসে।
এপ্রিল মাসের মধ্যভাগে মাগুরা মহাকুমার শালিখা থানার পুলুম নামক স্থানে যশোর অঞ্চলের নকশালদের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। পুলুম এলাকার অবস্থান যশোর শহর থেকে ৪২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এবং নড়াইল শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তরে। আবার মাগুরা সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিনে চিত্রা নদীর পাড়ে অবস্থিত নিভৃত পল্লী এলাকা। বর্ষাকালে পুলুম যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। শুকনো মওসুমে পায়ে হাঁটা পথ। মটর গাড়ীতে যাবার কোন সুযোগই ছিল না। এই পুলুম নামক স্থানে নকশালদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্থানটি খুবই উপযুক্ত। এই ঘাঁটি থেকেই বৃহত্তর যশোর জেলার নকশাল রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা হতো। লোহাগড়া থানার লাহুড়িয়ায় নকশালদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল।
নড়াইল লোহাগড়া আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক ছিলেন শরুসুনার শেখ আবদুস সবুর। এছাড়া গন্ডব, শরুসুনা, মহিশাহপাড়া, কুমড়ি ও ইতনায় নকশালদের ঘাঁটি ছিল। গন্ডবের মমতাজ, শরুসুনার শেখ সবুর, লাহুড়িয়ার তবিবর রহমান মনু জমাদ্দার ও মহিশাহপাড়ার রউপ নকশালদের নেতা ছিলেন। নকশালদের নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকার উপর দিয়ে ভারতে যাবার কয়েকটি রুট ছিল। নকশাল পার্টির কর্মীরা শরণার্থীদের নিরাপদে ভারতে যেতে সাহায্য করেছে। এই ঘাঁটির কারণেই মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতগামী শরণার্থীরা নিরাপদে যেতে পেরেছে। নড়াইল মহাকুমা ছাড়াও বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুর জেলার শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং গ্রহনের উদ্দেশে এই পথে ভারতে গেছে।
আওয়ামীলীগ নেতাদের অনুপস্থিতিতে নকশালদের এ ধরণের কিছু ভালো কাজ সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তারা সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যায় এবং জনপ্রিয়তা পায়। এসময় নকশালদের রাজনৈতিক কর্মসূচী সমর্থন না করলেও শুধু সামরিক ব্যবস্থার সমর্থনে দলে দলে লোক তাদের সাথে যোগ দেয়। অনেকে আবার বাধ্য হয়েও দলে ভেড়ে। তবে ব্যাপকহারে লোক দলে ভেড়ায় এবং যাচাই-বাছাই না করে দলে নেয়ায় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিহীন নেতৃতে¦র হাতে দলীয় ক্ষমতা চলে যায়। তাতে পার্টির শক্তি বৃদ্ধি পায় বটে কিন্তু পার্টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়।
দলীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্য না থাকায় নেতা-কর্মীরা বিতর্কিত কর্মকান্ড শুরু করে। আমাদের নিকটবর্তী মহিশাহপাড়া ও মঙ্গলহাটা গ্রামে নকশালদের দাপট ছিল সীমাহীন। তাদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত। যাদের মার্কসবাদ-লেলিনবাদ বা বিপ্লব সম্পর্কে নুন্যতম ধারণাও ছিল না। অথচ তাদের কথাবার্তা ও তত্বের দাপট শুনে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। মনে হতো স্বাধীনতার আগেই যেন মার্কসবাদী বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে।
‘শ্রেণী শত্রু খতমের’ নামে ওরা গ্রামের অবস্থাপন্ন গৃহস্থদের ধরে এনে গলাকাটা শুরু করে। অনেক স্থানে পুরানো শত্রুতা চরিতার্থ করার জন্য নীরিহ লোকদের হত্যা করে। জমিজমার মালিকদের জোতদার আখ্যা দিয়ে জোর করে তাদের জমির দলিল পত্র নিয়ে জমি-জমা ভাগ বাটোয়ারা করে দিতে থাকে। গ্রামে গ্রামে ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি শুরু করে। গ্রামের যে কোন গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে তাদের ২০/৩০ জন লোককে খেতে দিতে বাধ্য করতো অথবা চাল-ডাল দিতে বাধ্য করতো। অনেক বাড়ির সুন্দরী মেয়েটি অথবা গৃহবধুকে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য পাঠাতে বাধ্য করতো। মহিশাহপাড়ার মর্জিনা নামে এক সুন্দরী মহিলা এরকম বাধ্য হয়ে তাদের দলে ভেড়ে। পরে অবশ্য সে তাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডার হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে নি/র্মমভাবে হ/ত্যা করে।
কোন কোন স্থানে নকশালদের নামে ডাকাতির অভিযোগও রয়েছে। গ্রামের যুবকদের তাদের দলে যোগ দিতে বাধ্য করতো। কেউ তাদের সাথে যোগ না দিলে বা বিরোধিতা করলে তাকে অথবা তার অভিভাবককে ধরে নিয়ে গলা কেটে খুন করতো অথবা চোখ বেঁধে ক্যাম্পে আটকে রেখে সাজা দিত। ওরা আমার বড় ভাইকে দলে নিতে না পেরে আমার চাচা রফিউদ্দিন খানকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য ওই গ্রামের একজন মাতুব্বর ব্যক্তির অনুরোধে তিনি ছাড়া পান। এখন দেখি সেইসব লোকের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে বাকীরা হওয়ার জন্য দৌড়-ঝাঁপ করছে। কোন কোন গ্রামের মানুষ পাক আর্মি বা রাজাকার পিস কমিটির দ্বারা যতটুকু নির্যাতিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে নকশালদের দ্বারা।
এক পর্যায়ে মানুষ পাক আর্মির চেয়ে নকশালদের ভয়ে বেশি ভীত থাকতো। ওরা আতোষপাড়ার হাজী আবদুল্লাহ ওরফে হাজী সাহেব নামে একজন অত্যন্ত ভালো মানুষকে গলা কেটে মধুমতি নদীতে ভাসিয়ে দেয় এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র মহম্মদ মিয়াকে গলা কাটার জন্য নৌকার উপর রেখে কোপ দিলে তিনি পানিতে পড়ে যান। গুরুতর জখম অবস্থায় তিনি স্রোতে ভেসে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। সে এক অরাজক পরিস্থিতি। এসব কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই তারা সাধারণ মানুষের কাছে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যশোরের খ্যাতিমান সাংবাদিক প্রয়াত শামসুর রহমান সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেই স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব ও তাদের কর্মীরা ভারতে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত থেকে আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ইপিসিপি (এম এল) নেতৃত্বে দীর্ঘ আট মাস পার্টি বাহিনী জনগনকে রক্ষা করে। এর অসীম সাহসী যোদ্ধারা বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ করতে থাকে দখলদার বাহিনীকে। শহীদ হন অগণিত কর্মী। পার্টির এই ভুমিকা জনগনের কাছে তাদের আরও আস্থাশীল করে তুলেছিল। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত অজস্র লোক এসে সমবেত হয়েছিল পার্টির পতাকা তলে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তাদের এ অবদানের স্বীকৃতি দিতে অনেকে কুন্ঠিত। বরং দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহলে তাদের যুদ্ধকালীন ভুমিকা নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য শোনা যায় ’। লেখা চলবে । (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব।)