নিজস্ব প্রতিবেদক
শহরের দূর্গাপুর এলাকার নিরীহ প্রায় ৪০টি পরিবার সব সময় আতংকে থাকেন ভূমি দস্যুরা কখন তাদের জমি দখল করতে আসে। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত একটি চক্র এসব জমির মালেকদের হয়রাণী করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এক মহিলার নামে ক্রয়কৃত জমি দখলদাররা এসে পিলার পুতে রেখে গেলে নড়াইল পৌর মেয়র ও সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে সে পিলার তুলে ফেলেন।
জানা গেছে,নড়াইল পৌরসভার দূর্গাপুরর এলাকার দেবেন্দ্রনাথ গাংগুলি ৫ পূত্রের জন্য ৭৫ নং দূর্গাপুর-ডুমুরতলা মৌজায় প্রায় সাড়ে ৫ একর বসবাসের জমি রেখে গিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথের সন্তানরা পারিবাকিভাবে সম্পত্তির বন্টকনামা না করে আপোষমতে বিভিন্ন দাগের বিভিন্ন জমি ভোগ-দখল করছেন। তবে পারিবারিকভাবে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় প্রায় ৩৫ বছর ধরে তারা যে যার মতো করে নিজেদের অংশের জমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করছেন। এভাবে ৫ভাই সবার অংশই প্রায় বিক্রি করে দিলেও গত কয়েক বছর ধরে দেবেন্দ্রনাথের মেঝো সন্তান চতুর উত্তম গাংগুলি অপর ৪ভাই-এর বিক্রি করা জমিতে তার অংশ রয়েছে এ দাবি করে একটি জমি জালিয়াতি চক্রকে অর্থের বিনিময়ে পাওয়ার অব এটর্নি করে দিয়েছেন।
দূর্গাপুর এলাকার লিলা বিশ্বাস (৫৫) জানান,৩০ বছর আগে দেবেন্দ্রনাথের বড়ো ছেলে নিতাই গাংগুলীর কাছ থেকে ২৫শতাংশ বসবাসের জায়গা কিনে ভোগ-দখলে আছি। গত দু’মাস ধরে স্থানীয় আজিজার এই জমি দাবি করছে। শুনেছি নিতাই-এর ভাই উত্তম গাংগুলি নাকি আজিজার রহমানের কাছে এই জমি বিক্রি করেছে।
দূর্গাপুর এলাকার বাপ্পা বেগ(০১৭১২-৬৪৫০৬২) জানান, দূর্গাপুর-ডুমুরতলা মৌজায় এস.এ দাগ নং ২৭৫৩, ২৭৫৮.২৭৫৯ ও ২৭৬৫ এর স্বত্ত অনুযায়ী ১৪ শতাংশ জমি দেবেন্দ্রনাথের ছেলে উত্তম গাংগুলী, স্বপন গাংগুলি ও গৌর গাংগুলি ২০১১ সালে পাওয়ার অব এটর্নি মুলে সাবেক পৌর কাউন্সিলর রজিবুল বেগের কাছে বিক্রি করে। পরে ২০১৮ সালে মিরাজ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ওই জমি ক্রয় করেছি। গত বছরের নভেম্বর মাসে ডুমুরতলার আজিজার রহমান, জহুরুল মিয়া ও মুস্তাইন কাজী জানায় তারা এ জমি উত্তম গাংগুলির কাছ থেকে পাওয়ার অব এটর্নি মুলে ক্রয় করেছেন। এ সময় তারা জোরপূর্বক তার জমির সিমানা পিলার তুলে ফেলে দেয়। এ ঘটনার বিচার চেয়ে পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত দরখাস্ত করি।
দূর্গাপুর এলাকার ফয়সাল মোল্যা জানান, তার বোন শারমিন সুলতানা দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের পৈত্রিক জমি স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে দূর্গাপুর এলাকায় ১১শতক জমি ক্রয় এবং রেজিষ্ট্রি করলেও এখন স্থানীয় কাতেবর, অজিৎসহ কয়েকজন এসে ওই জমি দাবি করছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারী (শনিবার) তারা এ জমির দখল নিতে পিলারও পুতেছিল। পরে নড়াইল পৌর মেয়র ও সদর থানা পুলিশ এসে ওই পিলার সরিয়ে ফেলে।
দেবেন্দ্রনাথ গাংগুলীর সেজো পূত্র বিধান গাংগুলী (০১৯২৯-৬১৩৪৫৮) বলেন, দূর্গাপুর-ডুমুরতলা মৌজায় পৈত্রিকভাবে আমি ও আমার ছোট ভাই স্বপন গাংগুলী আপোষমতে ১৪ শতাংশ একটি পুকুরের মালিক। কিন্তু গত বছরের নভেম্বর মাসে ডুমুরতলা এলাকার আজিজার রহমান, জহুরুল মিয়াসহ কয়েকজন এসে জানায় এই পুকুর নাকি আমার ভাই উত্তমের কাছ পাওয়ার অব এটর্নি মূলে ক্রয় করেছে। এখন পুরের মাছ মারলে হত্যা ও ভারতে চলে যাবার হুমকি দেয়। বিষয়টি পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। পৈত্রিক জমির পারিবারিক বন্টকনামা না থাকায় ছোট ভাই উত্তম এ জালিয়াতির সুযোগ পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
স্থানীয় রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস (৮৫) জানান, ৩৫ বছর আগে উত্তম গাংগুলীর কাছ থেকে ২১শতাংশ জমি ক্রয় করলেও এখন তার ভাই বিধান ১০ শতাংশ জমি দাবি করে নিয়ে গেছে। দেবেন্দ্রনাথ গাংগুলীর বড় পূত্র নিতাই গাংগুলি (০১৭২৩-১২৬০৪১) বলেন,তার ছোট ভাই উত্তম এই জাল-জালিয়াতির সাথে যুক্ত। তিনি তার বিচার দাবি করেন।
আলাদাতপুর এলাকার সুমন আলী (০১৮৮৫-০৬৬২২৮) জানান, নিজের ইজিবাইক বিক্র করে আজিজারকে ৪ মাস আগে দূর্গাপুর এলাকায় ৫শতক জায়গার জন্য অগ্রিম হিসেবে ১ লাখ টাকা দেই। এখন খোঁজ-খবর নিয়ে দেখি ওই জমি নিতাই গাংগুলির। পরে টালবাহানা করতে করতে গত ৬ মার্চ সেই টাকা ফেরত দিয়েছে।
অভিযুক্ত উত্তম গাংগুলি (০১৯৪৮-৯৪০৪৫৯) তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বরং আমার ভাই বিধান গাংগুলী নিজের অংশ ছাড়াও আমার ভাগের জমি বিক্রি করেছে।
অপর অভিযুক্ত আজিজার রহমান (০১৭৯৬-২৬৮৬১২) বলেন, আমরা ২০১০ ও ২০১১ সালে কয়েকটি জমি উত্তম গাংগুলী কবলা দলিল ও পাওয়ার অব এটর্নি করে দিয়েছেন। এখানে আমরা কোন জালিয়াতির আশ্রয় নেইনি।
নড়াইল পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইপি রাণী বিশ্বাস (০১৭১৮-৮৪৬২০০) বলেন, স্থানীয় একটি দালাল চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করা জমি অন্যের নামে পাওয়ার অব এটর্নি করে দিচ্ছে। এভাবে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি নিরীহ পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে বিভিন্ন সময় নালিস ও সালিস হলেও এখনও পর্যন্ত কোন ফয়সালা হয়নি।
সদর থানার এস.আই আমীর (০১৭১২-৬৩৪৫৪১) বলেন, জমি দখলের খবর পেয়ে আমরা গিয়েছিলাম। পরে বিষয়টি মিমাংসার জন্য উকিল সালিসের সিদ্ধান্ত হয়।
নড়াইল পৌরসভার মেয়র আনজুমান আরা জানান, স্থানীয় একটি দালাল চক্র এই জমির জালিয়াতির সাথে জড়িত। আমি দখলদারদের দখল করা একটি জমি থেকে পিলার তুলে ফেলে দিয়েছি। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে সদর থানা পুলিশের দু’জন এস.আই ঘটনাস্থলে গিয়ে ভূক্তভোগিদের সাথে কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, ভূক্তভোগিরা রাতে ঘুমাতে পারছেন না। তাদের জমি ছেলে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। জমি জালিয়াতির সাথে জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান।
নড়াইল জজ আদালতের জিপি অচীন চক্রবর্ত্তী (০১৭১১-১১৬২৯৩) বলেন, দূর্গাপুর এলাকায় জাল জালিয়াতি করে জমি কেনা বেচার বিষয়টি শুনেছি। বিষয়টি দেখবার জন্য পুলিশ সুপার অনুরোধ করেছেন। যারা এসব জমি দাবি করছে তারা আমার কাছে দলিলপত্র জমা দিয়েছেন। এসব কাগজপত্র এখনও দেখেনি, দেখবো।
এ ব্যাপারে জেলা রেজিষ্ট্রার আব্দুর রহিম (০১৭১২-৩৯৩৫১৮) বলেন, জমি রেজিস্ট্রি করার পূর্বে সাব রেজিস্ট্রারকে অবশ্যই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দলিল করতে হয়। সৎ সাব-রেজিস্ট্রার হলে অবশ্যই এটা করবে। তবে দুর্বল বা দুর্নীতিপরায়ন সাব রেজিস্ট্রার এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই না করেই দলিল করতে পারে, তখন ব্যক্তি বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে পারে। এটা ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে বলে মন্তব্য করেন।