সেতু চালু হলে অপ্রশস্ত সড়কে দুর্ঘটনা ও ভোগান্তির আশঙ্কা
আবদুস ছালাম খান
ঢাকা-বেনাপোল ভায়া নড়াইল-লোহাগড়া-যশোর মহাসড়কের কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদীর উপর নির্মাণাধীন কালনা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট মহাসড়কটি প্রশস্তকরণের কাজ এখনও শুরু হয়নি। অথচ নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্থ্যাৎ পদ্মা সেতুর সাথেই চালুর লক্ষ্যমাত্রা ধরে কালনা সেতুর নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানা গেছে। মহাসড়কের বিদ্যমান ১৮ ফুট সড়কের সাথে আরো ৬ ফুট প্রশস্তকরণের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়নের কোন উদ্যেগ নেই। ফলে কালনা সেতু চালু হলে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে দুর্ঘটনা ও ভোগান্তি বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
কালনা সেতুর পশ্চিম পারে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা এবং পূর্ব পারে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা। পদ্মা সেতুর চেয়ে দুই লেন বেশি প্রশস্ত এবং দেশের প্রথম ছয় লেন এই কালনা সেতু চালু হলে লোহাগড়া নড়াইলসহ যশোর বেনাপোল খুলনা সাতক্ষীরা থেকে ঢাকাগামী যানবাহন মাগুরা-ফরিদপুর দৌলতদিয়া আরিচা পার হয়ে যাতায়াতের পরিবর্তে কালনা সেতু পার হয়ে সংক্ষিপ্ত পথেই ঢাকা যাবে। সঙ্গত কারণেই তখন এই মহাসড়কে কয়েকগুন বেশি যানবাহন চলাচল করবে। ফলে কালনা সেতু চালুর আগেই কালনাঘাট যশোর ভায়া লোহাগড়া নড়াইল যশোর সড়ক প্রশস্ত করা না হলে সড়কে যানজট সহ নানা ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে।
এশিয়ান হাইওয়ে ১ এর অংশ ছয়লেনের দৃষ্টিনন্দন এই সেতু চালু হলে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে। রাজধানী ঢাকার সাথে বিভাগীয় শহর খুলনার দুরত্ব ১২১ কিলোমিটার এবং যশোরের দুরত্ব ১১৩ কিলোমিটার কমে যাবে। এই সেতু চালু হলে দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর বেনাপোল থেকে কালনাসেতু হয়ে ঢাকার দুরত্ব হবে ২০১ কিলোমিটার এবং যশোর থেকে ঢাকার দুরত্ব হবে ১৬১ কিলোমিটার। বিভাগীয় শহর খুলনা থেকে ধলগা বসুন্দিয়া নড়াইল হয়ে ঢাকার দুরত্ব হবে ১৯০ কিলোমিটার। একইভাবে নড়াইলের দুরত্ব হবে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার অর্থ্যাৎ কমে যাবে ১৮০ কিলোমিটার। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীন ‘ক্রস বর্ডার রোড নেট ওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে’র আওতায় জাইকার অর্থায়নে এ সেতু নির্মান করা হচ্ছে। জাপানের টেককেন কর্পোরেশন ও ওয়াইবিসি এবং বাংলাদেশের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিঃ যৌথভাবে সেতু নির্মানের কাজ করছে।
গত শনিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে- নদীর পূর্ব পাড়ের সংযোগ সড়কের ১৩টি কালভার্টের ১২টির কাজ শেষ হয়েছে। ভাটিয়াপাড়া গোল চক্করের কাছে একটি কালভার্টের কাজ চলমান রয়েছে। নির্মাণাধীন কার্লভার্টটি পরবর্তীতে সংশোধিত প্রকল্পের আওতায় করা হচ্ছে। আটটি আন্ডার পাস নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। নদীর পূর্ব পাড়ে টোল প্লাজা নির্মাণ কাজ চলছে। এটি হবে ডিজিটাল টোল প্লাজা। উভয় পার্শ্বে মোট পৌনে চার কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে মাটির কাজ শেষ হয়েছে। পূর্ব পাড়ের সংযোগ সড়কের কার্পেটিং কাজ শুরু হয়েছে। পশ্চিম পাড়ের সংযোগ সড়কে বালি পাথর দিয়ে সমান করা হচ্ছে। সেতুর একটি পিলারের পানির উপরের অংশের কাজ এবং একটি স্প্যানের কাজ বাকী রয়েছে। সেতুর মাঝখানে ধনুকের মত বাঁকা সুদৃস্য ডিজাইন করা হয়েছে। যাকে বলা হয় ‘নেলসন লোস আর্চ টাইপের সেতু’ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এটি হবে দেশের সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন এবং প্রশস্ত সেতু। ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। তবে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই অর্থ্যাৎ পদ্মাসেতু চালুর সাথেই কালনা সেতু চালুর লক্ষ্য নিয়ে নির্মাণ কাজ দিন-রাত দুই শিফটে চলছে। সংশোধিত পরিকল্পনা অনূসারে কালনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। ছয় লেনের এই সেতুতে দ্রুত গতির চার লেনের উভয় পাশে একটি করে লেন কম গতির যানবাহন চলাচলের জন্য থাকবে। সেতু নির্মানে ব্যয় হবে ৯৫৯ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নড়াইলে এক নির্বাচনী জনসভায় ক্ষমতায় গেলে কালনা ঘাটে সেতু নির্মাণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কালনা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় মধুমতি নদীর উপর কালনা সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্প অনুমোদনকালে ২০১৪ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুন মাসে শেষ হবে বলে উল্লেখ ছিল। এ সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৭০ কোটি টাকা এবং সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ৬৮০ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ১৮.২০ মিটার। তখন কালনা সেতু ছিল চার লেনের। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের পর কালনা সেতুর সাথে রেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা ,জমি অধিগ্রহন ইত্যাদি নানা জটিলতার কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়। অবশেষে পৃথক রেল সেতু নির্মাণসহ সব জটিলতা কাটিয়ে ২০১৮ সালের ২৪ জুন সংশোধিত প্রকল্পে ছয়লেনের সেতু হিসাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। তখন প্রকল্পের মেয়াদ ৩৬ মাস ধরে ২০২১ সালের ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার সময়ে কাজ বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু জুন মাসে পদ্মাসেতু চালুর কারণে একই সাথে কালনা সেতু চালুর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ এগিয়ে চলেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের নড়াইল, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলাবাসীর কালনা সেতু পার হয়ে পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে ঢাকা যাতায়াত সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ হবে। এছাড়া স্থল বন্দর বেনাপোলের আমদানী-রফতানি পণ্যাদি পরিবহনেও এই সেতু ব্যবহার করা যাবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ খাজা মিয়ার সাথে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের মত বিনিময়কালে এই প্রতিবেদক ‘চার লেন মহাসড়কের সুবিধা পেতে কালনা সেতু চালুর সাথে সাথে বিদ্যমান কালনাÑযশোর মহাসড়কসহ অপ্রশস্ত ফিডার সড়ক গুলিকে প্রশস্তকরণের দাবী জানান। এ সময়ে এই সড়কের বিশেষ করে মালিরবাগ মোড় থেকে রূপগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত অংশটি মহাসড়ক হিসাবে ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপোযোগি বলেও জানানো হয়। তিনি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে দিবেন বলে জানান। কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ আশরাফুজ্জামান জানান-সব জটিলতা কাটিয়ে সেতু নির্মানের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে মোট কাজের ৬৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মাসেতুর সাথেই চালুর আশা নিয়ে রাতদিন দুই শিফটে কাজ চলছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ নড়াইলের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এ এম আতিকুল্লাহ জানান, কালনা ঘাট থেকে ভাঙ্গুড়া পর্যন্ত (নড়াইল জেলার অংশ) বিদ্যমান ১৮ ফুট সড়ককে ২৪ ফুটে উন্নীত করণ কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া শীঘ্রই শুরু হবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক)