এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় মা খ্যাত কংগ্রেস নেত্রী রঙ্গিনী বালা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত লোহাগড়া উপজেলার কুন্দশী গ্রামের শতবর্ষরোর্ধ বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসাবে সংরক্ষণ করে সংস্কার করা হলে এটি হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রায় ছয় একর জমির উপর নির্মিত বিশাল আয়তনের বাড়িটির অর্ধেক অংশে রঙ্গিনী বালা দেবীর অধঃস্তন বংশধরের এক আত্মীয় বসবাস করেন। রঙ্গিনী বালা দেবী কুন্দশী গ্রামের কৃতি সন্তান এবং নড়াইলের বিশিষ্ট আইনজীবী প্রয়াত গুরদাস ভট্টাচার্যের স্ত্রী এবং তদীয় পুত্র এ্যাডভোকেট মনিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মাতা। বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর সাহচর্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ এই নেতার স্মৃতি বিজড়িত জরাজীর্ণ বাড়িটি এখন কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে।
নড়াইলের বিশিষ্ট আইনজীবী প্রয়াত শরীফ আব্দুল হাকিম তাঁর ‘নড়াইল জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে জেলার কৃতি সন্তান পর্বে রঙ্গিনী বালা দেবী সম্পর্কে লিখেছেনÑ‘তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের নড়াইল মহাকুমা মহিলা শাখার সভানেত্রী ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাকে বড় মা বলে ডাকতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিশিষ্ট আইনজীবী গুরুদাস ভট্টাচার্যের স্ত্রী এবং মনিন্দ্র নাথ ভট্টাচার্যের মাতা ছিলেন।’
১২৯৭ বঙ্গাব্দে রঙ্গিনী বালা দেবীর স্বামী প্রয়াত গুরুদাস ভট্টাচার্য লোহাগড়া উপজেলার কুন্দশী গ্রামে বিশাল এই দ্বিতল বাড়িটি নির্মান করেন। ১৩০২ বঙ্গাব্দে এই বাড়ির নির্মান কাজ সম্পন্ন হয়। ভবনটি পূর্ব ও দক্ষিণ পোতা জুড়ে এল আকৃতির। ভবনের দক্ষিণ দিকে বিশাল খোলা চত্তর এবং পূর্ব দিকে ভবনের অনতি দূরে (বাড়ির সামনে) বিশাল ঘাট বাঁধানো পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে ভট্টাচার্য পরিবারের ঐতিহ্যবাহী পূজা মন্ডপ। চতুর্পার্শ্বে মাটির দেয়াল বিশিষ্ট পূজা মন্ডপটি একটি প্রতনতত্ত্ব সম্পদ। যা ঐতিহাসিক পূরাকীর্তি হিসাবে আজও ভট্টাচার্য পরিবারের ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে। এই পূজা মন্ডপের সামনে বিশাল আট চালা বিশিষ্ট নাট মন্দির ছিল।
তবে নাট মন্দিরটির এখন আর অস্তিত্ব নেই। কয়েক বছর পূর্বে এ বাড়ির বর্তমান মালিক নাট মন্দিরটি অপসারণ করে ফেলেছেন। ভবনের পূর্ব পাশ্বের্র মাঝ বরাবর বাড়ির ভেতরে প্রবেশের ‘সিংহ দরজা’ অর্থ্যাৎ প্রধান ফটক। পুকুর ঘাটে নামার সিড়িগুলির অধিকাংশ ভেঙ্গে গেলেও গ্রামবাসীরা এখনও পুকুরে নেমে গোসলের জন্য এই সিঁড়ি ব্যবহার করে থাকে। পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে গোল বৃত্তাকারে লেখা ‘বাবু গুরুদাস ভট্টাচার্য ,সন ১২৯৭ সাল’। ধারণা করা হয় বাড়ি নির্মানের একই সময়ে বাড়ির সামনের এই পুকুরটি খনন করে ঘাট বাঁধাই করা হয়। পুকুর ঘাটে স্থাপিত শিলা লিপিটি বাড়ি নির্মান ও পুকুর ঘাট বাঁধাই কালের স্বাক্ষ্য বহন করছে। রাজকীয় স্টাইলে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে জোছনা রাতে অথবা গ্রীস্মের সন্ধ্যায় বসে দখিনা হাওয়া গায়ে লাগানোর জন্য হেলান দিয়ে বসার চেয়ার সদৃশ্য আরামদায়ক আসন ব্যবস্থা আছে। যা আজও বিদ্যমান।
রঙ্গিনী বালা দেবীর স্বামী প্রয়াত গুরুদাস ভট্টাচার্যের পৈত্রিক নিবাস ছিল উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে। ব্রিটিশ ভারতে মল্লিকপুর গ্রামটি তখন ঐতিহ্যবাহী হিন্দু প্রধান গ্রাম। তৎকালে কলিকাতার সাথে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। মল্লিকপুরের ন্যায় কুন্দশীও তখন সম্ভ্রান্ত ব্রাম্মন প্রধান গ্রাম। তৎকালে কুন্দশী গ্রাম ‘ব্রাম্মন কুন্দশী’ বলে পরিচিত ছিল। ভট্টাচার্য পরিবার কুন্দশী গ্রামের অনেক জমির মালিক ছিলেন। অনেক জমি-জমার মালিক হওয়ার কারণে এই পরিবারকে কেউ কেউ জমিদার পরিবার বলে মনে করতো।
ধারণা করা হয় তৎকালে কুন্দশী গ্রামের ঐতিহ্যিক কারণে হোক আর জমি-জমা দেখা-শোনার সুবিধার্থে হোক তরুণ আইনজীবী গুরুদাস ভট্টাচার্য মল্লিকপুর ছেড়ে কুন্দশী গ্রামে এসে এই বাড়ি নির্মাণ করেন। তবে এই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা ডাঃ আশীষ ব্যানার্জী জানান- মাসিমার (রঙ্গিনী বালা দেবীর পুত্রবধু) কাছ থেকে শুনেছি শরীকদের সাথে বিরোধের কারণে গুরুদাস ভট্টাচার্য স্ত্রী রঙ্গিনী বালা দেবীকে নিয়ে কুন্দশী চলে আসেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী রঙ্গিনী বালা দেবীর যৌবনের স্মৃতি বিজড়িত শতবর্ষরোর্ধ কুন্দশী গ্রামের প্রাচীন এ বাড়িতে এখন ওই পরিবারের কেউই বসবাস করে না। কয়েক বছর পূর্বে এই পরিবারের সর্বশেষ বংশধর এ্যাডঃ বারিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও এ্যাডঃ রথিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য স্বপরিবারে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। ভারতে যাবার প্রাক্কালে ঐতিহ্যবাহী বিশাল এই সম্পত্তির ওয়ারিশ রথিন্দ্রনাথের অর্ধেকাংশ কিনে নেন লোহাগড়া পৌর সভার সাবেক মেয়র নেওয়াজ আহম্মেদ ঠাকুর। তবে বারিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার অংশ তাদেরই খালাতো ভাই ডাঃ আশীষ ব্যানার্জীকে দান করে যান। দান সূত্রে প্রাপ্ত ডাঃ আশীষ ব্যানার্জী তার অন্যান্য ভাইদের নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করলেও অযত্ন অবহেলায় বাড়িটি শ্রীহীন হয়ে পড়ে আছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী রঙ্গিনী বালা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে এখন আর দেশ বরেণ্য কোন ব্যক্তির আগমন ঘটে না বা রাজনীতির কোন কোলাহল সেখানে নেই। বিশাল দ্বিতল বাড়ির পুরো দেয়াল গাত্রের পলেস্তারা উঠে গিয়ে শেওলা জমে আছে। বহির্দেয়ালে পলেস্তারা বা কোন রংয়ের চিহ্ন নেই।
ভবনের দক্ষিণ দিকে বিশাল আকারের ১২টি গোলাকার পিলার স্থাপত্য কর্মের অনুপম নিদর্শনের স্মৃতি বহন করছে। পিলারগুলি মাটি থেকে সোজা দোতলায় উঠে গেছে। পিলারগুলিতে চন্দ্রাকৃতির বিশেষ ধরণের ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। মূল ভবনে ব্যবহৃত অধিকাংশ ইটগুলি বর্তমানের ইটের সাইজের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত বড় সাইজের। পুরো বাড়িটি প্রাচীন স্থাপত্য কর্মের নির্মাণ শৈলীর অপরূপ কারুকার্য খচিত। প্রতি তলায় ৫টি করে কক্ষ রয়েছে। ইট গুলিতে এখনও নোনা ধরেনি। নীচ তলায় বিশাল বৈঠকখানা (কনফারেন্স রুম)। যা রাজকীয় পরিবারের স্মৃতি বহন করে। বৈঠক খানাটির দেয়াল গাত্রে বিভিন্ন লতা-পাতা সদৃশ্য কারুকার্য খচিত। বৈঠকখানার দেয়াল গাত্রে লেখা আছে ‘যত ধর্ম তত জয়’।