লোহাগড়ায় ষন্মথ দত্তের স্মৃতিবিজড়িত শতবর্ষরোর্ধ কালনার বাড়িটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র

0
40
সার ও বীজ বিতরণ

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান

নড়াইল জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেশ বরেণ্য-এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অনেক কৃতিসন্তানের স্মৃতিবিজড়িত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলি অযত্নঅবহেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থাপনাগুলি সংস্কার করে সংরক্ষণ করা হলে এ গুলি হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ভারতের জাতীয় দলের অধিনায়ক ও কলিকাতা মোহনবাগান ফুটবল দলের ক্যাপটেন ষন্মথ দত্ত ও তদীয় সহোদর মন্মথ দত্তের স্মৃতিবিজড়িত লোহাগড়া উপজেলার কালনা গ্রামের বাড়িটি এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই বাড়িটি প্রখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পি গীতা দত্তের পূর্ব পুরুষেরও বাড়ি বলে এই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা কার্ত্তিক চন্দ্র ঘোষ দাবী করেন। প্রায় পাঁচ একর জমির উপর নির্মিত শতবর্ষরোর্ধ একতলা ভবনটি এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ০৬ মে কালনা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী দত্ত পরিবারের এই বাড়িতে কিংবদন্তী ফুটবলার ষন্মথ দত্ত জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম প্রিয়নাথ দত্ত। প্রিয়নাথ দত্তের তিন ছেলের মধ্যে ষন্মথ দত্ত ছিলেন সকলের বড়। ১৩১৩ বঙ্গাব্দে প্রিয়নাথ দত্ত কালনা গ্রামে এই একতলা ভবনটি নির্মান করেন। তৎকালে কালনা গ্রামটি মধুমতি ও নবগঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম।

বিখ্যাত নদী বন্দর ও কলিকাতা থেকে আগত স্টীমারঘাট এবং বিখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র বলে পরিচিত ছিল কালনা । বর্তমান কালের লোহাগড়া থানা তখন কালনায় ছিল। নাম ছিল ‘কালনা থানা’। ১৮৬১ সালে নড়াইল মহাকুমা গঠনের পর কালনা থানা লক্ষীপাশায় স্থানান্তর করে নামকরণ করা হয় ‘লোহাগড়া থানা’।
কালনা গ্রামে তখন বিশাল ফুটবল মাঠ ছিল । ছাত্র অবস্থা থেকেই ষন্মথ দত্তের ফুটবল খেলার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। কালনা গ্রামের এই মাঠেই ষন্মথ দত্ত কিশোর বয়স থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত ফুটবল খেলেছেন। ভারতের জাতীয় ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পরও তিনি কালনার মাঠে ফুটবল খেলেছেন।

কামঠানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামান্য দক্ষিনে আজও সেই ফুটবল মাঠটি কালের স্মৃতি বহন করে চলেছে। লোহাগড়া ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যান) নগেন্দ্র নাথ সাহার কন্যা অর্চনা রানী সাহা (৮৩) জানান- তিনি ছোট বেলায় তার বাবার সাথে কালনা-কামঠানার মাঠে গিয়ে ষন্মথ দত্তের ফুটবল খেলা দেখেছেন। দেশ বিদেশের অনেক নামী-দামী ফুটবল খেলোয়াড় তখন এই মাঠে ফুটবল খেলতে আসতো। শিক্ষা ও কর্মজীবনে ডাঃ ষন্মথ দত্ত অবিভক্ত ভারতের কলিকাতায় অবস্থান করলেও বিভিন্ন সময়ে পরিবারের সাথে যোগ দিতে নিয়মিত বাড়ি আসতেন। বিভিন্ন পূজা-পার্বণের সময়ে কালনা-কামঠানা মাঠে আয়োজিত ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহনের উদ্দেশে তিনি কলিকাতার নাম করা ফুটবল খেলোয়াড়দের সাথে নিয়ে আসতেন।

চরকরফা গ্রামের প্রাক্তন ইউপি মেম্বর সোহরাব সিকদার (৭২) জানান- ‘ফুটবল ক্রীড়াঙ্গণে ঐতিহ্যবাহী দত্ত পরিবারের বিশেষ পরিচিতি ছিল। দত্ত বাড়ির যুবকদের নিয়ে একটি ফুটবল টিম হতো বলে তৎকালে লোকমুখে প্রচার ছিল ’। গুগল সূত্র থেকে জানা যায়Ñ ডাঃ ষন্মথ নাথ দত্ত ছিলেন একজন বাঙ্গালি কিংবদন্তী ফুটবলার। যিনি কলিকাতার মোহন বাগান ফুটবল দলের সেন্টার হাফ ও পরবর্তীতে সেন্টার ব্যাকে খেলতেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলিকাতা মোহন বাগান ফুটবল দলে খেলেছেন।

তিনি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলিকাতা মোহন বাগান ফুটবল দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিখিল ভারত ফুটবল দলের অধিনায়ক হয়ে দক্ষিন আফ্রিকায় খেলতে যান। ১৯৩৫ সালে চীনের অলিম্পিক দল ‘লি ওয়াই টাং’ ভারতে খেলতে আসলে তিনি ভারতের জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাতীয় ফুটবল খেলা থেকে অবসর নেন। তবে তিনি ফুটবল খেলা এবং ক্রীড়াঙ্গণ ছাড়েন নাই। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মোহন বাগান ফুটবল ক্লাবের সম্পাদক হন। গুগল থেকে আরো জানা যায় ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে সমধিক পরিচিত ষন্মথ নাথ দত্ত পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তার স্ত্রী সুধা রাণী দত্ত পশ্চিম বাংলা বিধান সভার ১৯৫১ ,১৯৬২ ও ১৯৬৭ সালে এম এল এ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

কালনা সেতুর অনতি দুরে ঢাকা-বেনাপোল মহাসড়কের উত্তর পার্শ্বে কিংবদন্তী ফুটবল খেলোয়াড় ও ফুটবল কর্মকর্তা ষন্মথ দত্তের স্মৃতি বিজড়িত কালনা গ্রামের এই বাড়িতে দত্ত পরিবারের কেউ বসবাস করেন না । ষন্মথ দত্তের চাচাতো বোন বলে পরিচিত সাধনা দত্তের পরিবার বর্তমানে এই বাড়িতে বসবাস করেন। দত্ত পরিবারের বিশাল আয়তনের বাড়ির অধিকাংশ জমি এখনও তাদের মালিকানায় আছে। তবে কালের স্বাক্ষী দত্ত বাড়ির সেই ঐতিহ্য আজ আর নেই।

ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির শতবর্ষরোর্ধ ভবনটিও এখন সেই পুরাণো আদলে নেই। গত কয়েক বছর আগে বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছে। কড়ে-বর্গার ছাদ ফেলে নতুন করে আরসিসির ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে। সামনের বারান্দায় ছাদের পরিবর্তে টিনের চাল দেওয়া হয়েছে। এই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা কার্ত্তিক চন্দ্র ঘোষ জানান- ‘তার মা সাধনা দত্ত ষন্মথ দত্তের চাচাতো বোন। অর্থ্যাৎ ষন্মথ দত্ত তার চাচাতো মামা। তিনি বলেন-মায়ের কাছ থেকে শুনেছি- প্রখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পি গীতা দত্ত তার মায়ের দুই সিড়ি পূর্বের চাচাতো বোন। অর্থ্যাৎ কালনার এই বাড়িটি তারও পূর্ব পুরুষের বাড়ি। দেশ বিভাগের পর থেকে ষন্মথ দত্ত স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করতেন। তবে দেশ বিভাগের আগে তিনি পূজা-পার্বণে নিয়মিত কালনার বাড়িতে আসতেন এবং কালনার মাঠে ফুটবল খেলতেন। তিনি আরো জানান- বসবাসের সুবিধার্থে ভবনটির কিছু সংষ্কার করা হয়েছে। দেওয়ালে কিছু কিছু জায়গায় নোনা ধরে পলেস্তরা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংষ্কারকালে ভবনটির নির্মাতার নাম ও নির্মান সাল লেখা ফলকটি মুছে ফেলতে বাধ্য হয়েছি’। ১৯৮২ সালে কিংবদন্তী এই ফুটবলারের জীবনাবসান ঘটে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক)