আবদুস ছালাম খান
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত লোহাগড়া উপজেলার ইতনা স্কুল এন্ড কলেজ চত্ত্বরে স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৃহৎ একটি ম্যুরাল উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। ১৭ ফুট উচু এবং ১০ ফুট প্রশস্ত কংক্রিটের দেওয়ালের উপর ১০ ফুট উচু এবং ৮ ফুট প্রশস্ত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালটির নির্মান কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। আট লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ম্যুরালটি নির্মানে অর্থায়ণ করেছেন ওই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব এবং কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতি উজ্জল গাঙ্গুলি ও তার পরিবার। কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবী এটি নড়াইল জেলায় নির্মিত বঙ্গবন্ধুর সর্ববৃহৎ ম্যুরাল।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে-গত ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট শোক দিবসের এক আলোচনা সভায় কলেজের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কলেজ গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যূরাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের কয়েকদিন পরই প্রথম বারের মত উজ্জল গাঙ্গুলি গভর্নিং সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি শিক্ষকদের এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে নিজে ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে সর্ব বৃহৎ একটি ম্যুরাল নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে সম্মত হন। সেইমত খুলনার বিশিষ্ট স্থাপত্য শিল্পি মিঠুন মন্ডলকে ম্যুরাল নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি নির্মান কাজ শুরু করেন এবং ডিসেম্বর মাসে কাজ শেষ করেন। গত ৮ মে ৯৪ নড়াইল ২ আসনের সংসদ সদস্য ও ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তজা আনুষ্ঠানিক ভাবে ম্যুরালটি উদ্বোধনের জন্য দিন ধার্য করেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি নিজ বাসায় অকস্মাৎ হাঁটুতে জখমপ্রাপ্ত হওয়ায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়। তিনি পুনরায় সময় দিলে উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
উল্লেখ্য ইতনা গ্রাম ও ইতনা স্কুলের সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই স্কুলের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প করে ট্রেনিং দেয়া হতো। এসমসয় ভারতগামী শরণার্থীদের জন্য ইতনা স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল।
শরণার্থীদের আশ্রয় কেন্দ্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের সংবাদ স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভাটিয়াপাড়ার সেনা ক্যাম্পে পৌছে যায়। তারই জের ধরে পাকসেনার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে নির্মম মা/রপিট করে জ/খম করা চরভাটপাড়ার অনিল কাপালীর বাড়ি ইতনা গ্রামে এই মিথ্যা অজুহাত তুলে ২৩ মে ১৯৭১ ভাটিয়াপাড়ার পাক সেনারা ইতনা গ্রামে নির্মম গণহত্যা চালিয়ে এই স্কুলের শিক্ষক হিরু মাস্টার এবং চার সহোদরসহ অর্ধশত লোককে হত্যা করে। গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে ইতনা স্কুল ও কলেজের সামনে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ শহীদদের স্মৃতিধারণ করে স্বগর্ভে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে লোহাগড়া থানা দখলের দিনে রাজাকারদের গুলিতে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল ইতনা স্কুল চত্ত্বরে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের এইরুপ একাধিক করুণ স্মৃতি আজও ইতনাবাসীদের মনে দগদগে হয়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মরণে ইতনা স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন স্মরণীয় দিন আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে থাকে।
ম্যুরাল নির্মান প্রসঙ্গে কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অনিন্দ্য সরকার জানান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখতে ইতনা স্কুল ও কলেজ প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ,হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল আমাদের চেতনাকে আরো শাণিত করবে। ম্যুরাল নির্মাণ কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম জানান, ইতনা স্কুল ও কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত ম্যুরালটি নির্মাণে এ পর্যন্ত আট লক্ষ চুয়ান্ন হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই ম্যুরালটি আকারে নড়াইল জেলার সর্ব বৃহৎ।
ম্যুরাল নির্মাণ কাজে অর্থায়ণকারী ও ইতনা স্কুল ও কলেজ গভর্ণিং বডির নবনির্বাচিত (২য়বার) সভাপতি উজ্জল গাঙ্গুলি জানান, আমার বাবা সর্গীয় বিশ্বনাথ গাঙ্গুলি মুক্তিযুদ্ধকালে ইতনা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ইতনা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। আমাদের বাড়িতে শরণার্থীদের ক্যাম্প ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমার বাবা ইতনা ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি স্কুল ও কলেজের একাধিক বার সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের অনেক ভুমিকা রয়েছে। তাছাড়া ইতনা কলেজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের পরিবার ও আমার মাতৃকুলের আনেক অবদান রয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখতে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।