এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান
১৮৬১ সালে নীল বিদ্রোহের সময় তৎকালীন বৃটিশ সরকার যশোর জেলার পুর্বাঞ্চলে প্রশাসনিক সুবিধা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে মুলতঃ নীল বিদ্রোহ দমনে একটি মহাকুমা (অধুনালুপ্ত) গঠনের উদ্যোগ নেয়। তখন নবগঠিত মহাকুমার সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য অন্যান্য স্থানের সাথে লোহাগড়ার নামটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। কিন্তু তৎকালে নড়াইলের প্রভাবশালী জমিদারদের কারণে অবশেষে তাদের গ্রামের নামানুসারে নড়াইল মৌজার তিন কিলোমিটার দুরবর্তী মহিষখোলা মৌজায় তৎকালীণ নীল কুিঠয়াল সাহেবের বাংলোয় সদর দপ্তর স্থাপন করে নামকরণ করা হয় নড়াইল মহাকুমা। তবে এর আগে মধুমতি ও নবগঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থল কালনা নদী বন্দরে ‘কালনা থানা’ নামে একটি থানা ছিল। অধুনামৃত নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী তৎকালীন কালনা থানার সেই এলাকাটি আজও থানার ঘাট নামে লোকমুখে পরিচিত। কিন্তু নড়াইল মহাকুমা নামে নতুন প্রশাসনিক এলাকা গঠনের পর থানা সদর প্রশাসনিক এলাকার মধ্যবর্তী এলাকায় স্থানান্তরের আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন থানা সদর লক্ষীপাশায় স্থানান্তর করা হলেও নামকরণ করা হয় লোহাগড়া থানা। লোহাগড়া নামক গ্রামটি তখন প্রভাবশালী চারটি জমিদার পরিবারের বসতি এলাকা। জমিদার পরিবার একে অপরের সাথে সর্বদা শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতো। লোহাগড়ার ঐতিহ্য ও গর্ব করার মত যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা জমিদারদের এই প্রতিযোগিতার ফসল বললেও অত্যুক্তি হয়না।
লোহাগড়ার এই জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই ১২০০ বঙ্গাব্দে লোহাগড়া বাজারের গোড়াপত্তন হয়। বাজারটি ধীরে ধীরে বৃহৎ ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি পায়। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত আইনজীবী রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় লোহাগড়া উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়। যা পরবর্তীতে যদুনাথ একাডেমী নামকরণ হয়ে বর্তমানে লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত।
১৯০৭ সালে দার্শনিক ডঃ মহেন্দ্রনাথ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহী রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরি। যার অবস্থান সারা দেশে টিকে থাকা প্রাচীনতম লাইব্রেরি গুলির মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির মধ্যে। ১৯৬৮ সালে যদুনাথ মজুমদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয় লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয়। যা বর্তমানে ‘লোহাগড়া সরকারি আদর্শ কলেজ’ নামে পরিচিত। অর্থ্যাৎ শত বৎসর আগেও লোহাগড়া নামক গ্রামটি ছিল লোহাগড়া থানার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেদ্রবিন্দু। লোহাগড়ার ঐতিহ্য ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান গুলির সে অবস্থান যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। একসময়ে লোহাগড়ার খাঁটি দুধের মিষ্টি দেশে এমনকি পশ্চিম বাংলায়ও সুনাম ছিল। দেশের অনেক দুষ্প্রাপ্য ঔষধ শহরের বড় বড় ফার্মেসীতে না পাওয়া গেলেও লোহাগড়া বাজারে পাওয়া যেত। অনেক কৃষি পণ্য লোহাগড়া থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হতো। আগে হাটের দিনে লোকের ভীড়ে পথ চলা দুষ্কর ছিল। লোকের ভীড় এড়াতে অনেকে বিশেষ করে মহিলারা হাটের দিন দুপুরের পর বাইরে বের হতো না। লোহাগড়ায় এখনও সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে। অথচ এখন কবে হাটের দিন তা বোঝা যায় না।
৯০ দশকে লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয়, লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও লোহাগড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের বুনিয়াদী স্তর হিসাবে বিশেষভাবে বিবেচিত হত। প্রতিষ্ঠানদ্বয় এ অঞ্চলের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়। সেরা এই তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারণে অনেক দুর-দুরান্ত থেকে অভিভাবকরা লোহাগড়ায় এসে বাসা ভাড়া করে থেকে তাদের ছেলেমেয়েদের এখানে পড়াতো। দুর-দুরান্তের লোকজন এসে বাড়ি ভাড়া করে থাকায় তখন লোহাগড়ায় বাড়ি ভাড়াও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে লোহাগড়ার শিক্ষাঙ্গনের সে সুনাম হঠাৎ করেই যেন ম্লান হয়ে গেছে। একইভাবে লোহাগড়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গণও ঝিমিয়ে পড়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী লোহাগড়ায় রামনায়ণ পাবলিক লাইব্রেরির মত শতবর্ষরোর্ধ প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃতির উন্নয়ণে এখানে কোন কর্মসূচী থাকে না। বলতে গেলে আজও উল্লেখযোগ্য কোন সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠেনি। নামে মাত্র কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকলেও তাদের কোন কার্যক্রম এখন আর চোখে পড়ে না। অথচ মাত্র এক দশক আগেও লোহাগড়ায় একাধিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছিল। লোহাগড়ার শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের মনের অজান্তেই সব ঐতিহ্যই যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি করণ করায় স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা শিক্ষার বিষয়ে সব দায়িত্ব ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা চুপচাপ আছেন। অথচ শিক্ষিত লোকেদের এই নিশ্চুপ থাকাটা লোহাগড়ার কত বড় ক্ষতি হচ্ছে তা কেউ একবারও ভেবে দেখছেন না। লোহাগড়ার ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৪ বছর আগে সরকারি করণ করা হলেও আজও একজন পূর্ণাঙ্গ প্রধান শিক্ষক আনা যায় নি। ভারপ্রাপ্ত দিয়েই ৪ বছর পেরিয়ে গেল।
লোহাগড়া কলেজে ‘ভালো লেখাপড়া হয়না’ এই ধুয়ো তুলে লোহাগড়ার শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। অথচ লোহাগড়ার সচেতন মহল থেকে আমরা কখনো এর কারণ উদঘাটন করে প্রতিকারের চেষ্টা না করে কেবলমাত্র কয়েকজন চাকুরী করতে আসা শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে আছি।
১৯০৩ সালে উপজেলা সদরের ৪টি ইউনিয়নের নাম প্রধান গ্রাম সহ ১৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত পৌরসভার নামকরণ করা হয় লোহাগড়া পৌরসভা। পৌরসভা গঠনের এই ১৮ বছরেও লোহাগড়ার কেউ পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়নি। পৌর এলাকার রাস্তাগুলি চলাচলের সম্পূর্ণ অযোগ্য। মাঝে মাঝে দুই একটি রাস্তা সংস্কার করা হলেও তা এতই নিম্নমানের কাজ হয় যে নির্মাণের কিছুদিন যেতে না যেতেই পূর্বাবস্থা হয়ে যায়। পৌরভবনের জন্য স্থান নির্ধারণ করে বিপুল অর্থ ব্যয়ে মাটি ভরাট করা হলেও আজো সেখানে পৌর ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পদ্মা সেতু,কালনা সেতুসহ প্রস্তাবিত ঢাকাÑবেনাপোল চারলেন মহাসড়ক এবং ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ তথা ট্রান্স এশিয়ান রেললাইন লোহাগড়ার উপর দিয়ে যাওয়ায় লোহাগড়া এখন আন্তর্জাতিক সড়ক ও রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতাধীন। মহান মুক্তিযুদ্ধে লোহাগড়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
লোহাগড়া বাজার সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশাল মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে সংগঠিত অবস্থায় থাকে। অথচ স্বাধীনতার এই ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো লোহাগড়ায় স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদ স্মৃতি ফলক এমনকি পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র সন্মুখ যুদ্ধস্থান কালনায় আজও কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা যায়নি। অথচ কয়েকদিন আগেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি।
শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ঐতিহ্যবাহী লোহাগড়ায় অনেক শিক্ষিত ও সচেতন লোক রয়েছে। আমরা লোহাগড়ার এসব বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে পারি না ? অন্যথায় লোহাগড়ার শিক্ষা-সংস্কৃতির শত বছরের ঐতিহ্য আমাদের অজান্তেই হারিয়ে যাবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক)।