সাদিয়া ইসলাম
নড়াইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
শিক্ষা প্রতিটি শিশুর জন্মগত মৌলিক অধিকার। সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর।বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু একটি ব্যাপক অর্থ নির্দেশক শব্দ। আমরা সাধারণত অনেক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শব্দটি ব্যবহার করি। প্রতিবন্ধী শব্দটি নেতিবাচক, যেখানে একজন ব্যক্তিকে ছোট করে দেখা হয়। আর বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শব্দের মাধ্যমে নির্দেশ করা হয় শিশু বা ব্যক্তির এমন কিছু বিশেষ চাহিদা রয়েছে যা পূরণ করলে সে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারবে।
প্রতিবন্ধী অক্ষম মানুষেরা চিরকালই সমাজে সবলদের দ্বারা উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। অথচ ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সদাচরণ, সাহায্য-সহযোগিতা এবং অন্যদের ওপর তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিপদ-আপদে সব সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো মানবতা ও সচেতন নাগরিক হিসেবে পবিত্র দায়িত্ব। প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে অসদাচরণ, উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-তামাশা করা সৃষ্টিকে তথা আল্লাহকে উপহাস করার শামিল।এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো, যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও পথনির্দেশ করেন।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত: ১-৩) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬)
সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। একজন প্রতিবন্ধী সমাজে সুস্থ-সুন্দরভাবে বিকশিত হয়, যদি দেশের অবকাঠামো ভালো হয়। যেমনভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ (প্রতিবন্ধী) ব্যক্তির খোঁজখবর নাও এবং বন্দীকে মুক্ত করে দাও।’ (বুখারি)
প্রতিবন্ধীত্ব বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা। বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে প্রতিবন্ধীত্বের উপর বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। খানার আয় ও ব্যয় জরীপ ২০১০ অনুযায়ী, অক্ষমতার হার মোট জনগোষ্ঠির ৯.১ শতাংশ, যদিও ২০১১ সালের জাতীয় আদম শুমারী অনুযায়ী এ হার শতকরা ১.৭ শতাংশ। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি হলো এই যে, প্রতিবন্ধী শিশু মূল যে প্রতিবন্ধকতার সন্মূখীন হয় সেটা তার বৈকল্য নয়, বরং সেটা হলো ব্যাপক বৈষম্য এবং কুসংস্কার। প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার লঙ্ঘনের মূলে রয়েছে পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য। সমাজের সর্বস্তরে এরূপ একটি বিশ্বাস আছে যে, প্রতিবন্ধীত্ব একটি অভিশাপ এবং এটি পাপ কাজের শাস্তি যা প্রতিবন্ধীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ যত্ম, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা এবং অংশগ্রহণের সুযোগকে প্রভাবিত করে। প্রতিবন্ধী শিশুরা স্বাস্থ্যসেবা অথবা বিদ্যালয়ে যাওয়ার সবচেয়ে কম সুযোগ পায়। বিশেষ করে তাদেরকে লুকিয়ে রাখলে কিংবা প্রতিষ্ঠানে দিলে অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ সকল গোষ্ঠির মধ্যে তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন, অপব্যবহার, শোষণ এবং অবহেলার শিকার হয়। লিঙ্গও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় কারন ছেলের তুলনায় প্রতিবন্ধী মেয়েরা কম খাদ্য ও যত্ন পায়।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী। ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক একটি সনদ (সিআরডিপি) গৃহীত হয়। এ সনদ ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়। প্রতিবন্ধী শিশুর পরিস্থিতি বিশ্লেষণে (২০১৪) দেখা যায় যে, শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুরা বাংলাদেশে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ৯৭ শতাংশ হলেও মাত্র ১১ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু যে কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়।প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য গৃহিত উদ্যোগগুলো বিশেষায়িত এবং আলাদা। এ ধরনের উদ্যোগগুলো মূলধারার কর্মসূচি ও সেবার আওতার বাইরে থেকে যায়।জন্মনিবন্ধন না করার মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী অনেক শিশুর জীবনের প্রথম থেকেই বঞ্চণার শুরু হয়। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কারণে তারা সামাজিক সেবা ও আইনগত নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়।
যে সকল শিশুর ইন্দ্রিয় ক্ষমতা বুদ্ধি বা শারীরিক ক্ষমতা এতটাই ভিন্ন যে কারণে তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা বা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজন হয়। সেই সকল শিশুকে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বলে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বলতে সেই সব শিশুদের বুঝায় সমবয়স্কদের তুলনায় যাদের বুদ্ধি সংবেদন, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ভাব বিনিময় ক্ষমতা ও সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মাত্রার কম বা বেশী হয় তাকেই ব্যতিক্রমী শিশু বলে আখ্যায়িত করা হয়।
অর্থাৎ যারা সাধারণর বাইরে তারাই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু । বুদ্ধাংকের দিক থেকে বলা যায় যাদের বুদ্ধাংক ৭৫ এর নিচে এবং ১২০ এর উপরে বা বাইরে তারাই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর লক্ষণাবলী:
১। বুদ্ধি : সাধারন শিশুদের তুলনায় বুদ্ধিমত্তা গড় মানের চেয়ে কম বা বেশি হয়।
২। সংবেদনঃ সংবেদন ক্ষমতার পার্থক্য হয়, এর মধ্যে যেমন চোখ ও কান প্রধান আবার তেমন শোনার ও দেখার পার্থক্য হয়।
৩। ভাববিনিময়ঃ ভাববিনিময় করার ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়।
৪। আচরণগত পার্থক্যঃ আচরনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী শিশুর মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।
৫। শারীরিক ক্ষমতাঃ শারীরিক নড়াচড়া অর্থাৎ অঙ্গ সঞ্চালন দক্ষতার অক্ষমতা। ইচ্ছামত নড়াচড়া করতে পারে না।
৬। সামাজিক দক্ষতাঃ সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে অক্ষম হয় বা পার্থক্য দেখা যায়।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর প্রকারভেদ :
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন –
(১) প্রতিভাবান শিশু,
(২) প্রতিবন্ধী শিশু।
বিভিন্ন ধরনের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু আমরা দেখতে পাই।
যেমন-
শারীরিক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন
দৃষ্টিতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন
বাক ও শ্রবণে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন
বুদ্ধির বিকাশজনিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন
মানসিক ও আবেগিক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন
ধীর শিখনজনিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন
অটিজম/অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারজনিত
সেলিব্রাল-পালসিজনিত
ডাউন-সিনড্রোমজনিত ইত্যাদি
শিশুর আইকিউ ‘ইন্টেলিজেন্ট কৌশেনট’কে সংক্ষেপে ‘আইকিউ’ নামে অভিহিত করা হয়। জার্মান সাইকোলজিস্ট উইলিয়াম স্টার্ন ১৯১২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কারও বুদ্ধির মাত্রা নিরূপণের জন্য আইকিউ স্কোর নির্ণয় করা হয়। এ জন্য নানা ধরনের মানসম্মত টেস্ট আছে। এর যেকোন একটি ধরে আইকিউ স্কোর করে নেওয়া হয়।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে নিম্নের তত্ত্বগুলো প্রয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনঃ
চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ
করণ শিক্ষণ
পরিহার শিক্ষণ
অন্তর্দৃষ্টিমূলক শিক্ষণ
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিষয়টি মাথায় রেখে নড়াইল সদর উপজেলার মাইজপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত বোড়ামারা অটিজম ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করি। ১৩৮ জন শিক্ষার্থী সম্বলিত বিদ্যালয়টি পাচটি টিন শেড ঘরে ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউজিডিপি প্রকল্পের আওতায় ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বিদ্যালয়টির নতুন ভবনটির টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, নির্মাণ কাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
বাবা-মা শিশুদের নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার একটি বড় কারন হল বাংলাদেশে এই ধরনের শিশুদের চিহ্নিত করা, তাদের Intervention দেওয়া, শিক্ষা দেওয়া সর্বোপরি তাদের সামাজিক ভাবে পূনর্বাসন করার জন্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম। এই সকল শিশুদের নিয়ে সামাজিক সমস্যা অনেক। বাবা-মা বেশীরভাগ সময়ই এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যান না। কিন্তু যদিওবা সাহস করে তাদের এই ধরনের অনুষ্ঠানে নিয়েও যান, সাধারন মানুষ বেশীর ভাগ সময়ই এদেরকে স্বাভাবিক ভাবে নেন না। এই ধরনের শিশুদের সাথে অনেক সাধারন শিশুর বাবা-মাই চাননা তাদের স্বাভাবিক বাচ্চাটা মিশুক।বেশিরভাগ বাবা-মাই এই ধরনের শিশুদের সাথে থাকলে নিজ সন্তানদের ক্ষতির আশঙ্কা করেন। এর ফলে সাধারন শিশুদের মনেও এই বিশেষ শিশুদের নিয়ে নেতিবাচক ধারনার জন্ম দেয়।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বেশীরভাগ বিদ্যালয়ই গ্রহণ করতে চায় না। শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু এবং দৃষ্টিতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা কিছুটা সুযোগ পেলেও শ্রবণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও বুদ্ধির বিকাশ জনিত ক্ষতিগ্রস্থ শিশুদের জন্য মূল ধারার বিদ্যালয়গুলো কোন সুযোগই দিতে চায় না। যে সকল শিশুরা বিদ্যালয়ে সুযোগ পায় তাদের বেশীরভাগই আবার ঝরে যায়। এর প্রধান কারনই হল বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানেন না তাদের কিভাবে পড়াতে হবে। তাই বিদ্যালয়ে বিশেষ শিশুদের জন্য সুষ্ঠ পরিবেশ থাকে না। যেমন শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য র্যামের ব্যবস্থা করা, দৃষ্টিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য ব্রেইল পেপারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
উচ্চ শিক্ষায়ও রয়েছে এই ধরনের শিশুদের জন্য নানা বাধা। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়গুলোর সংখ্যা এমনিতেই কম যে কারনে সাধারন শিক্ষার্থীরাই সুযোগ পায় না সেখানে এই ধরনের শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়াটা আরো কষ্ট সাধ্য। যে সকল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা বা ন্যুনতম শিক্ষা শেষ করে তাদের চাকরীর ক্ষেত্রে পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। যেমন যে সকল ব্যক্তির দৃষ্টিতে সমস্যা রয়েছে তারা যেসফটওয়্যার ব্যবহার করে অনায়াসে কম্পিউটার ব্যবহার (টাইপ, ইন্টারনেট ব্যবহার, মেইল রিডিং, মেইল সেন্ডিং, চ্যাটিং,) করতে পারে তা আমাদের বেশীর ভাগ কম্পানীগুলো জানেনা বলে এই চাকরীগুলোতে দৃষ্টিতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের সুযোগ দেওয়া হয় না। সরকারী চাকুরীতে বিশেষ ব্যবস্থায় এই ধরনের ব্যক্তিদের সুযোগ প্রদান করলে বেসরকারী ব্যক্তিরা এদের চাকুরী দিতে উৎসাহ পাবে।
সংকট উত্তরণের উপায় ও আমাদের করণীয়:
১। সরকারীভাবে বিশেষ শিশুদের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রচার চালানো যেতে পারে। যেমন করে পোলিও নিয়ে করা হয়েছে। এই ভাবে প্রচার করলে মানুষ সচেতন হবে। কমে আসবে শিশুদের প্রতিবন্ধী হওয়া।
২। এই ধরনের শিশুদের সব ধরণের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী আইন দরকার।
৩। সরকারের একার পক্ষে এই ক্ষেত্রে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই সরকার বেসরকারী খাতে সহযোগীতা বাড়ালে তাদের পক্ষেও এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও শিশুদের সহযোগিতা করা সম্ভব হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সংকটে রয়েছে তাদের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করলে প্রতিষ্ঠানগুলো আরো ভালোভাবে শিশুদের জন্য কাজ করে যেতে পারবে। বিশেষ করে বিশেষ শিক্ষার বিদ্যালয় গুলোকে বেশী করে আর্থিক সহযোগিতা করা উচিত।
৪। সরকারী ভাবে সহায়ক উপকরণ প্রস্তুত করার ব্যবস্থা করা উচিত। তাছাড়া বেসরকারী ভাবে এই ধরনে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সকার উৎসাহ এ সুবিধা প্রদান করলে সমস্যা উত্তরন অনেকাংশেই সম্ভব হবে।
৫। সরকারী ভাবে বিশেষ শিশুদের জন্য সুবিধা বাড়ালে তাদের পূণর্বাসন সহজ হবে। কোন ব্যক্তি সরকারী চাকুরীতে সফলতা দেখাতে পারলে এটি সব বিশেষ শিশুদের দক্ষতার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে অনেক বেশী অবদান রাখতে পারবে। সরকার বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য চাকুরীর খাত নির্ধারন করে দিয়ে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেই খাতে বিশেষ ব্যক্তিদের নিতে বাধ্য করলে বা উৎসাহিত করলে বিশেষ ব্যক্তিদের চাকুরীর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
৬। সরকারি-বেসরকারিও আবাসিক ভবনগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। তাই এগুলোতে বিশেষ শিশুদের চলাচল মারাত্মক বাধাগ্রস্থ হয়। তাই সরকারের উচিত সব ধরনে ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া।
৭। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে যাতায়াত মাধ্যম ও পথ-ঘাট বিশেষ শিশুদের উপযোগী করা।
৮। উচ্চ শিক্ষায় বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে সুযোগ সৃষ্টি করা এবং একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশেশ শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা।
উন্নয়নের ধীরগতির সত্ত্বেও পরিমার্জন এবং সামাজিক সচেতনতার কারণে পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যায়। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকারের বাড়তি সুযোগ এবং দক্ষতার বিকাশ ও চাকুরীর সুযোগ তৈরী হচ্ছে।বাংলাদেশের শিশুদের জন্য সুরক্ষা আইন, বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সেবার উন্নতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।১৯৯৩ সালে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী সমন্বয় কমিটি গঠিত হয় যা জাতীয় প্রতিবন্ধী নীতিমালা, ১৯৯৫ প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। তখন থেকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আইনী কাঠামো সমন্বয় করা হচ্ছে।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ অনেকগুলো আইন প্রণয়ন করেছে ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যেমন – শিশু নীতি ২০১১, শিশু আইন ২০১৩ এবং প্রতিবন্ধীর অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ সনদ (সিআরপিডি) এবং ২০০৮ সালে ঐচ্ছিক প্রোটোকলে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর অন্যতম। সিআরপিডি রাষ্ট্রের প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরসহ সকল নাগরিকের মানবাধিকারের পূর্ণ ও সমান অধিকার ভোগ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এ সনদটি বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের অবস্থার পর্যালোচনা এবং সমাজে তাদের অন্তর্ভূক্তির জন্য পদক্ষেপের ভিত্তি স্থাপন করে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সমাজ থেকে আড়াল করে, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে সমাজ তথা দেশের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব নয়। শিক্ষক ও সচেতন অভিভাবকের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সদিচ্ছাই পারে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব সমাজ ও দেশ সৃষ্টি করতে,যেখানে তাদের জন্য কল্যাণ নয়, অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হবে, সহমর্মিতা নয় সহযোগিতা করা হবে। এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে অটিজম ইস্যুটিকে প্রাধান্য দেওয়াসহ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এসব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে সমাজেও ধীরে ধরে বিশেষ শিশুদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা কমে আসছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঈদ কার্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান সেখানে কয়েক বছর ধরে অটিস্টিক শিশুদের ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে।আমরা যদি তাদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটু সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই, একটু বিশেষ নজর দেই, তবে তাদের মূলধারার শিক্ষায় নিয়ে আসা সম্ভব।আর দশটি সুস্থ শিশুর মতো তারাও সমাজের সার্বিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে সফলতার পরিচয় দিতে সক্ষম-তারা সংসারে বোঝা নয়। আমরা চাই তারা মানুষের মতো মানুষ হোক। তাদের জীবন সাফল্যের আলোয় আলোকিত হোক।