আবদুস ছালাম খান, লেখক, সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক
লোহাগড়া উপজেলায় দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে সর্বশেষে নির্মিত মধুমতি নদীর কালনা ঘাটে নির্মিত দৃষ্টি নন্দন মধুমতি সেতু ও ঢাকা-বেনাপোল ভায়া ভাঙ্গা ভাটিয়াপাড়া-লোহাগড়া-নড়াই-যশোর মহাসড়ক অন্যতম। আধুনিক স্থাপত্য কর্মে নির্মিত ছয় লেনের ব্যতিক্রমী এমন সেতু বাংলাদেশে এই প্রথম।
পদ্মাসেতুর চাইতে দুই লেন বেশি এবং সেতুর মাঝখানে স্টীলের তৈরী বিশেষ ভাবে বাঁকানো সুদৃশ্য ডিজাইন সেতুটিকে বেশি দর্শণীয় করেছে। স্থাপত্যকর্মের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘নেলসন লোস আর্চ টাইপ ডিজাইন’। দ্রুতগতির চারটি মুল লেনের উভয় পার্শ্বে কম গতির আরো দু‘টি লেনসহ ৬ লেনের এ সেতুর দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার। সেতুর উভয় পার্শ্বে এ্যাপ্রোচ সড়ক ৪ দশমিক ৩০ কিলোমিটার। কালনা সেতু নির্মানে ব্যয় হয় প্রায় ৯৫৯ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা। জাইকার আর্থায়নে এই সেতু নির্মান করে জাপানের টেককেন কর্পোরেশন ও ওয়াইবিসি এবং বাংলাদেশের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিঃ। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারী কালনা সেতু নামে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৪ জুন ২০১৮ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হিসাবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ‘ক্রস বর্ডার রোড নেট ওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের’ আওতায় ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর এই সেতু নির্মানের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
২০২০-২০২১ সালে করোনা মহামারীসহ নানান কারণে সেতু নির্মান কাজে বিলম্ব হয়। তবে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্মান কাজ শেষে গত ১০ অক্টোবর ২০২২ কালনা সেতু নাম পরিবর্তন করে ‘মধুমতি সেতু’ নামে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেতুর শুভ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরদিন ১১ অক্টোবর মধুমতি সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কালনা সেতুসহ ঢাকা-বেনাপোল মহাসড়ক চালু হওয়ায় দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষের অর্ধ শতাব্দীর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এই সেতুসহ মহাসড়ক চালু হওয়ায় রাজধানীর সাথে এ অঞ্চলের মানষের সড়ক যোগাযোগে দীর্ঘদিনের দুর্দশা লাঘব হয়েছে। মধুমতি সেতুর পশ্চিম পারে নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলা এবং পূর্ব পারে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা। ফলে সেতুটি উভয় পারের মানুষের কাছেই স্বপ্নের সেতু। যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পর থেকে প্রতিদিন উভয় পারের শতশত দর্শণার্থী তাদের স্বপ্নের সেতু দেখতে ভীড় করছে।
উল্লেখ্য স্বাধীনতার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের রাজধানীর সাথে সহজ সড়ক যোগাযোগের জন্য ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত একটি মহাসড়ক নির্মানের পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ১৯৭৮ সালে ‘ঢাকাÑখুলনা শর্ট ’ রুট নামে ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে মাওয়াঘাটে পদ্মানদীর উপর সেতু নির্মাণসহ ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া হয়ে খুলনা পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মানের পরিকল্পনা করা হয়। এশিয়ান হাইওয়ে-১ ও এশিয়ান হাইওয়ে-২ নামে মহাসড়ক নির্মাণ পরিকল্পনা অনুসারে মহাসড়ক নির্মানের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ পর্যায়ক্রমে অনেক অগ্রগতি হতে থাকে। এ দু‘টি নির্মান পরিকল্পনার মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ে -১ ঢাকা থেকে মাওয়া ,ভাঙ্গা হয়ে ভাটিয়াপাড়া গোল চত্তর থেকে লোহাগড়া-নড়াইল-ফুলতলা-নওয়াপাড়া হয়ে খুলনা।
অপরদিকে এশিয়ান হাইওয়ে-২ ভাটিয়াপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাটের কাটাখালি হয়ে খুলনা। এশিয়ান হাইওয়ে-২ বিল-খাল ও নদীতীর দিয়ে মহাসড়ক নির্মাণ পরিকল্পনা থাকায় পরিকল্পনাটি অধিকতর ব্যয়বহুল ছিল। ফলে অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে মহাসড়ক নির্মান করা সম্ভব হবে বিধায় প্রথমোক্ত পরিকল্পনাটি গৃহিত হয় এবং খন্ড খন্ডভাবে মহাসড়ক নির্মান কাজ চলতে থাকে। সেইমত আশির দশকে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণ বাদে মাওয়া-ভাটিয়াপাড়া অংশেও সড়ক নির্মানে মাটির কাজ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের লোহাগড়া থেকে নড়াইল-ফুলতলাÑখুলনা অংশের কাজের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেক। উক্ত কাজের অংশ হিসাবে ১৯৯৪ সালে নড়াইলের মালিরবাগ নামক স্থানে ‘প্রস্তাবিত ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক’ লিখিত তীর চিহ্ন সংবলিত সাইনবোর্ড টানানো হয়। এসময় লোহাগড়ায় নবগঙ্গা নদীর উপর ও নড়াইলে চিত্রা নদীর উপর সেতু নির্মান কাজ শুরু করা হয়। তখন কালনা ঘাটে উন্নত মানের ফেরি আনা হয়। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের অংশ হিসাবে দু‘টি নদীর উপর সেতু নির্মান কাজ শুরু হলে নড়াইল-লোহাগড়ার মানুষ আশায় বুক বাঁধে। তবে সরকার পরিবর্তন জনিত কারণসহ বিভিন্ন কারনে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক নির্মান কাজ বিলম্বিত হতে থাকে। উল্লেখ্য ঢাকা-খুলনা শর্ট রুট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহনের পর সরকার পরিবর্তনজনিত কারনে কাজের গতি কম-বেশি হলেও মহাসড়ক নির্মানের গতিপথ পরিবর্তনের মূল পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয় নাই।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গতিপথ পরিবর্তনের পরিকল্পনা হতে থাকে। এ সময় আমি (লেখক) যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক লোকসমাজ’ সংবাদপত্রের লোহাগড়া প্রতিনিধি। মহাসড়কের গতিপথ পরিবর্তনের পরিকল্পনা পূর্বাহ্নেই জানতে পেরে উক্ত সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য একটি প্রতিবেদন পাঠাই।
নড়াইল-লোহাগড়ার মানুষের অতি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি লোকসমাজ কর্তৃপক্ষও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে “ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক নির্মানের গতিপথ পাল্টে যাচ্ছে ! ভেঙ্গে যাচ্ছে নড়াইলবাসীর স্বপ্ন” শিরোনামে উক্ত প্রতিবেদনটি ওই পত্রিকার ০৩ মে ১৯৯৯ সংখ্যায় ব্যানার হেডলাইনে (বড় হরফে) ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার পর নড়াইল-লোহাগড়ার নেতৃস্থানীয় অনেক নেতা এর সত্যতা সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চান। আমি এই প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করলেও নেতৃবৃন্দকে কার্যকর কোন ভুমিকা নিতে দেখা যায় না। আমি তাদের দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ না দেখে এ বিষয়ে আবারও “ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক যাচ্ছে গোপালগঞ্জ হয়ে। স্বপ্নে বিভোর নড়াইলবাসীর পাজর ভাংছে” শিরোনামে একই পত্রিকার ২২ জুন ২০০০ সংখ্যায় আরো একটি রিপোর্ট করি।
ওই রিপোর্টে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক লোহাগড়া নড়াইল হয়ে নির্মানের পক্ষে ভবিষ্যত সুবিধা হিসাবে ‘ভাটিয়াপাড়া গোল চত্ত্বর থেকে এগিয়ে মধুমতি নদীর কালনাঘাটে সেতু নির্মাণসহ লোহাগড়া-নড়াইল হয়ে মহাসড়ক নির্মাণ করা হলে ভবিষ্যতে কেবলমাত্র নড়াইল থেকে যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণ করলে ‘ঢাকা-বেনাপোল’ মহাসড়কের সুবিধা পাওয়া যাবে বলে যুক্তি দেখাই। পরবর্তীতে একই পত্রিকার ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সংখ্যায় আবারও এ বিষয়ে সরাসরি শিরোনাম দিয়ে অর্থ্যাৎ ‘ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক বঞ্চিত নড়াইলবাসী এবার স্বপ্ন দেখছে ঢাকা-বেনাপোল ভায়া নড়াইল সড়কের’ শিরোনামে রিপোর্ট করি। কিন্তু কোন রিপোর্টে তৎকালে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে নড়াইল-লোহাগড়বাসীর সাথে আমিও হতাশ হয়েছিলাম। ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক শেষ পর্যন্ত লোহাগড়া-নড়াইলের উপর দিয়ে হয় নাই। তারপরও বৃহত্তর মহাসড়ক প্রাপ্তির আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নড়াইল-লোহাগড়া বাসীর স্বপ্নের সেই ঢাকা-বেনাপোল মহাসড়ক আজকে বাস্তবায়ন হচ্ছে। কালনা ঘাটে ছয় লেনের সুদৃশ্য মধুমতি সেতু জনসাধারণ ও যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। কালনা সেতুর উদ্বোধনী ফলকে ‘ঢাকা-বেনাপোল ভায়া মাওয়া মধুমতি সেতু’ লেখা ভিত্তিপ্রস্তর শোভা পাচ্ছে। ছয়লেনের মধুমতি সেতুর সাথে মিল রেখে ৬ লেনের মহাসড়ক নির্মান কাজ শেষ হলে লোহাগড়া-নড়াইলের গণমানুষের স্বপ্নের ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক হারানোর ক্ষত মুছে যাবে। এটিই হবে লোহাগড়া-নড়াইলের সর্বশেষে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্য কর্মের সেরা দর্শনীয় স্থান।