নিউজ ডেস্ক
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর অংশ হিসেবে আজ বিকেলে এখানে এক মহাসমাবেশে দেয়া ভাষণে তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট চেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাদেরকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই আগামী নির্বাচনেও আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন।’
বিএনপি আমলের অরাজকতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি সন্ত্রাস, হত্যা রাহাজানি, নির্যাতন আর জেল, জুলুম, মামলা ব্যতীত জনগণকে কিছুই দিতে পারে নাই। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যশোর জেলা স্টেডিয়ামে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ‘আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন কি না,’ দুই হাত তুলে ওয়াদা করতে বললে জনতা দ্ইু হাত তুলে চিৎকার করে তাতে সম্মতি দেয়।
প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকে রিজার্ভ ও তারল্য নিয়ে বিএনপি-জামায়াত চক্রের ছড়ানো গুজব সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই গুজবে কান দেবেন না কারণ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে এবং ব্যাংকে অর্থের কোনো সংকট নেই। যদিও, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা থাকায় ব্যাংকে টাকা নিয়ে আমাদের কোন সমস্যা নেই। আর ব্যাংকে টাকা নেই এই কথাটা মিথ্যা। গতকালকেও তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ মিটিং করে দেখেছেন টাকার কোন সমস্যা নাই। প্রত্যেকটা ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে বলেন তিনি ।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের রেমিট্যান্স আসছে, বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে, আমদানী-রপ্তানী আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, ট্যাক্স কালেকশন বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশে^র অন্য দেশ যেখানে হিমসিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী আছে।
যশোর জেলা স্টেডিয়াম ও এর আশপাশের গলি-পথসহ এলাকার জনসমাগম এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। যশোর ও এর আশেপাশের জেলা থেকে আওয়ামী লীগ এর ফ্রন্ট ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের ভোর থেকে জনসভাস্থলে জমায়েত হতে থঅকে। ব্যাপক জনসমাগমে সমগ্র এলাকা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক জনসমুদ্রে রূপ নেয়।
বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে শেখ হাসিনা নৌকা আকৃতির মঞ্চে উঠলে বিভিন্ন স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। সভায় আরো বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ও জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং শেখ হেলাল এমপি।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশ পরিচালনা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার, এমপি।
রিজার্ভ নিয়ে সমালোচনার জবাবে সরকার প্রধান বলেন, অনেকে এখন রিজার্ভ নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা করা হচ্ছে। অথচ আমাদের সরকার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়েছে। আর কোনো সরকার রিজার্ভ এত বাড়াতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘অনেকে প্রশ্ন করেন, রিজার্ভ গেল কোথায়? আমরা তো রিজার্ভ অপচয় করিনি। মানুষের কল্যাণে কাজে লাগিয়েছি। জ্বালানি তেল কিনতে হয়েছে, খাদ্যশস্য কিনেছি। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। করোনার টিকা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেছি। এসব কাজে রিজার্ভ থেকে খরচ করতে হয়েছে আমাদের। কারণ, আমরা সবসময় মানুষের কথা চিন্তা করে উন্নয়ন কর্মকা- চালাচ্ছি। দেশের মানুষ যেন কষ্ট না পায়, ভাল থাকে সেজন্য খরচ করতে হয়েছে। রিজার্ভের টাকা মানুষের কল্যাণের জন্যই ব্যয় হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছেড়ে যায় তখন দেশের রিজার্ভ ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে সেই রিজার্ভ আমরা ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পেরেছিল। অথচ তারাই আবার রিজার্ভ নিয়ে কথা বলে। তিনি বলেন, বিএনপি জনগণকে কিছুই দিতে পারেনি। তারা শুধু মানুষের রক্ত চুষে খেতে পারে। এটাই হল বাস্তবতা।
প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দেন, অস্ত্র চোরাকারবারি করতে গিয়ে তারেক জিয়া ধরা খেয়েছিল, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এবং সেখানেও তার সাজা হয়েছে। আর খালেদা জিয়া জনগণের অর্থই শুধু মারেননি পাশাপাশি এতিমের অর্থও মেরে দিয়েছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা মেরে সেও আজকে সাজাপ্রাপ্ত। কাজেই, সাজাপ্রাপ্ত যে দলের নেতা সেই দল জনগণকে কি দেবে সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
এই বৈশি^ক মন্দা মোকাবিলায় সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সম্ভব সব ধরণের চাষাবাদ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারও জমি যেন অনাবাদি না থাকে। প্রত্যকটা জমি আবাদ করতে হবে। যাতে আমাদের খাদ্য ঘাটতি না হয়।
আজকে যে স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী জনসভা করলেন তা জরাজীর্ণ এবং ঝুকিপূর্ণ উল্লেখ করে এর আধুনিকায়ন করে দেবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ১১ স্তর বিশিষ্ট আধুনিক গ্যালারি সমৃদ্ধ স্টেডিয়াম গড়ে তুলতে ইতোমধ্যে ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলেও জানান। এ সময় মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকতে ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতি তাঁর আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি যুব সমাজের উদ্দেশে বলেন, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা এবং লেখাপড়া করতে হবে। তিনি এ বিষয়েও যুব সমাজের ওয়াদা নেন এবং মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে তাদের দূরে থাকতে বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শান্তি চাই, উন্নতি চাই, আমাদের যুব সমাজ আমাদের ভবিষ্যত। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে তাদেরই সবাইকে মিলে এদেশকে গড়ে তুলতে হবে এবং এদেশের উন্নতি করতে হবে।
তিনি এ সময় বিনা জমানতে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের সুবিধা এবং সরকার প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধা নিয়ে উদ্যোক্তা হবার জন্যও যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
পদ্মা সেতু বিনির্মাণের ফলে সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সব কিছু পাল্টে গেছে। প্রত্যেক এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি। এই সেতু হওয়ার পর খুব দ্রুতই এ অঞ্চলের মানুষ যাতায়াত ও পণ্য সরবরাহ করতে পারছে। যশোর এয়ারপোর্টকে আরও আধুনিক করা হচ্ছে, যশোর থেকে কক্সবাজার বিমান চলাচলও শুরু হয়েছে। যশোরের অভয়নগরে ইপিজেড স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে ৪শ’র মতো শিল্প স্থাপন করা হবে, বিপুল সংখ্যেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলযোগাযোগ ব্যবস্থাও আমরা গড়ে তোলা হবে।
করোনা ভাইরাস মহামারী মধ্যে দীর্ঘদিন কোন জনসভায় অংশ নিতে পারেননি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আমার প্রথম জনসভা এই যশোরে।’
তিনি বলেন, যে যশোরের মাটিতে আমার নানা শুয়ে আছেন, যে যশোর মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরাট অবদান রেখেছে, যে যশোর খেঁজুরের গুঁড়ের যশোর, ফুলের যশোর, উন্নয়নের একটা দৃষ্টান্ত সেই যশোরে জনসভা করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর এই বাংলাদেশের একটি মানুষ না খেয়ে থাকবে না, একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না, একটি মানুষও রোগে ধুঁকে মরবে না, প্রত্যেকটা মানুষের জীবনমান উন্নত হবে, সমৃদ্ধশালী হবে। আমরা সেই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি এবং তা বাস্তবায়ন করেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
‘আর তার জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই, আপনাদের দোয়া চাই। আপনাদের আশীর্বাদ চাই,’ বলেন তিনি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মা, বাবা, ভাই সব হারিয়েছিলাম। সেই হারাবার ব্যথা বেদনা, বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না, মামলা করার অধিকার ছিল না। বিচারহীনতার কালচার ছিল। সেই দুঃখ বেদনা নিয়েও এই বাংলার মাটিতে ফিরে এসেছিলাম শুধু আপনাদের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য। যে মানুষের জন্য আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য গড়াই তাঁর কাজ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যতটুকু আমার সাধ্য আছে পাশে থেকে আমি আপনাদের সেবা করে যাব।’
বারবার হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হলেও প্রাণে বেঁচে যাওয়ার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বারবার এই আঘাত থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন বোধহয় আমার উপর দায়িত্ব দিয়েছেন বাংলার জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করবার। ইনশাল্লাহ এই বাংলাদেশ দরিদ্র থাকবে না, এই বাংলাদেশ উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে। ‘আজকে এই ওয়াদা দিয়ে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী। (সূত্রঃ বাসস)