স্টাফ রিপোর্টার
নড়াইলের বধ্যভূমি পাকবাহিনী ও তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগী আলবদর-রাজাকারদের সৃষ্ট। নড়াইল জেলা জজ আদালতের ২৫ গজ দূরে ডাক অফিসের দ্বিতল বাড়ির পেছনে রয়েছে এই বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতন চালায় পাকবাহিনী। নির্যাতন-ধর্ষণের পর ক্যাম্পের পেছনে দেয়াল ঘেরা জঙ্গলে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হত তাদের, কারো কারো পেট ফেঁড়ে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী নারকীয় হত্যাকান্ড, ধর্ষণ, নির্যাতন এর মতো জঘন্য অপরাধ করেছে। নড়াইল জেলার নদীগুলোতে গণহত্যার পর লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হত, পাড়েও ফেলে রাখা হত অসংখ্য লাশ। শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত করা হয়েছে গণকবর, বদ্ধভূমি, স্মৃতিসৌধ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডের সদর দপ্তর করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এমপিএ শহীদ আলী খান, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক করে বিশাল বাহিনী যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন।
এ দিকে নড়াইলের জামায়াত নেতা মাওলানা সোলায়মান ও আওয়াল মন্ডলের নেতৃত্বে ‘শান্তিবাহিনী গঠিত হয়’। এ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে দেশপ্রেমিক শত শত মানুষকে ধরে এনে নড়াইল ডাকবাংলোয় আটকে রাখা হত। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে মাওলানা সোলায়মান রেজিস্ট্রারে যাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে ‘রিলিজ ফর ইভার’ লিখে দিত, তাদের গভীর রাতে নড়াইল শহরের লঞ্চঘাটের প্লাটুনের ওপর নিয়ে গিয়ে গলা কেটে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হত। এভাবে মাওলানা সোলায়মান ও আওয়াল মন্ডল চেনা অচেনা সহস্রাধিক মানুষকে গলা কেটে হত্যা করে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।
মাওলানা সোলায়মান ও আওয়াল মন্ডলসহ অন্য্যা রাজাকাররা তুলারামপুরের আওয়ামী লীগের সদস্য, নড়াইল ভিসি স্কুলের মাস্টার শহীদ আতিয়ার রহমান তরফদার, শহীদ আ. সালাম তরফদার, শহীদ মকবুল হোসেন সিকদার, শহীদ মাহাতাব তরফদার, শহীদ মোকাম মোল্যা, শহীদ কাইজার মোল্যা, শহীদ আলতাফ হোসেন তরফদার, শহীদ রফিকুল উদ্দিন তরফদার, ও চাচড়া গ্রামের শহীদ ফয়জুর রহমানসহ অনেককে ধরে এনে শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় নিয়ে হত্যা করে কবর খুঁড়ে সেখানে পুতে রাখে। যেটা এখন গনকবর হিসাবে চিহ্রিত করে নড়াইল মুক্তদিবস.বুদ্ধিজীবি দিবস,বিজয় দিবস ও স্বাধিনতা দিবসে ফুলের মালা দিয়ে সরকারী ভাবে পালন করা হয়।
এ বিষয়ে শহীদ মকবুল হোসেন সিকদারের ছোটবোন জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ইসমত আরা বলেন, নড়াইল মুক্তদিবস.বুদ্ধিজীবি দিবস,বিজয় দিবস ও স্বাধিনতা দিবসে ফুলের মালা দিয়ে সরকারী ভাবে পালন করা হয়। জীবিত কবর দেওয়া এসব শহীদদের মধ্যে শুধুমাত্র শহীদ রফিকুল উদ্দিন তরফদারকে রাস্ট্রীয় স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের দৃষ্টি আকর্ষন করছি যেন অচিরেই বাকী সকল শহীদদের রাস্ট্রীয় স্বীকৃত দেওয়া হয়।
এছাড়া নকসালরা পেড়লী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আ. হামিদ মোল্যা, আবুয়াল হোসেন, নায়েব নজির হোসেনসহ অনেককে হত্যা করে। ৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপক ভাবে মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে প্রচুর ক্ষতি করে। এরপর নড়াইল শহর জন শূন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের কাছে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়।
এদিকে ক্যাপ্টেন দোহারের উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আওড়িয়ায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এ কারণে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হতে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় গানবোট যোগে ইতনা গ্রামে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়।
এভাবে শত কষ্টের মাঝেও দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় উজির আলী, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী, কালিয়া থানায় ওমর আলী এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর,শেখ আজিবর রহমান, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান, কালিয়া থানায় আব্দুল মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করা হয়। পরে তারা নড়াইলে প্রবেশ করে।
অক্টোবর মাস হতে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশিদিন টিকতে পারবে না। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিকে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার গণ আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়।
তবে তারা আত্মসমর্পণ না করায় ৮ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ আরও অনেক গ্রুপ এক হয়ে সম্মিলিত ভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করে। প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী শেখ আজিবর রহমান,এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহের নেতৃত্বে নড়াইল কলেজের দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে এই যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
মিজানুর রহমানের মৃতদেহ হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখে। পরে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে। এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর রাতে বিজয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আ. হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালায়। তবে পাল্টা আক্রমণে বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন।
এ সময় শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা অস্বীকার করেন। এ সময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চারদিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেলহাজতে পাঠানো হয়।
প্রবল ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকে ও জয় বাংলা শ্লোগানে শহর মাতিয়ে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর সকালের দিকে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। পরে মুক্তি পাগল হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলের ৫ জন খেতাবপ্রাপ্ত হলেন- ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান।