নিজস্ব প্রতিবেদক
নড়াইলের লোহাগড়ায় ১৯৭১ সালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দানকারী জাহানারা বেগম (৭৮) ২০১৮ সাল থেকে নিজ বাড়িতে নাতী-নাতনী ও বাড়ির পাশের শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনান।এবার নাতি-নাতনী ও তাদের সহপাঠিদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতে চট্রগ্রাম গেলেন । ২০১৮ সালে তিনি প্রথম নাতীনাতনীদের উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনান। এরপর থেকে প্রতি বছর নাতীনাতনী ও বাড়ির পাশের শিশুদের উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনিয়ে থাকেন। কিন্তু এবছর জাহানারা বেগমের চট্রগ্রামে যেতে হলো। কারন তার ছোট মেয়ে শাহিনুর পারভীন ৩ ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থলে চট্রগ্রাম থাকেন। তার ছোট ছেলেকে স্কুলে ভর্তির কারনে অন্য বছরের মত এবার ডিসেম্বরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামে নানীর নিকট থেকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতে পারবেনা । এতে ছেলেমেয়েদের মন খারাপ হয়। ছেলেমেয়েদের মন খারাপ দেখে শাহিনুর পারভীন তার মাকে তার ছেলেমেয়ে ও তাদের সহপাঠিদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতে চট্রগ্রাম যেতে বলে। জাহানারা বেগমের শরীর তেমন ভাল না থাকলেও তিনি চট্রগ্রামে যেতে রাজি হয়ে যান। ১৯৭১ সালে যেভাবে শক্তি সাহস নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, ঠিক তেমনি মনের জোরে নাতি-নাতনী ও তাদের সহপাঠিদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতে চট্রগ্রাম গেলেন।
গত ৬ ডিসেম্বর রাতে ঈগল পরিবহনে করে জাহানারা বেগম তার যশোরে বসবাসকারী মেয়ে রাশিদা পারভীন,নাতী আহনাফ তাহমিদ বাঁধনএবং নাতনী আয়মা নওশিনকে সাথে। ভোর ৫টায় চট্রগামে পৌঁছান। জাহানারা বেগম আশি এবং নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকবার চট্রগ্রামে গিয়েছিলেন ছেলে এবং মেয়ের বাসায়। সে সময়ে চট্রাগ্রাম যেতে ৪টি ফেরি পার হয়ে সময় লাগত ২৪ থেকে ৩৬ ঘন্টা। এবার তিনি মাত্র ৮ঘন্টায় চট্রগ্রাম পৌঁছানোর পেছনে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার অভূত পূর্ব উন্নয়ণের প্রশংসা এবং শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
কিছুদিন বিশ্রামের পর গতকাল ২৮ (ডিসেম্বর) সকালে মেয়ের বাসার সামনে নাতীনাতনী ও তাদের সহপাঠিদের নিয়ে উঠান বেঠকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতে বসেন। নাতী নাতনী ও তাদের সহপাঠিরা মুগ্ধ হয়ে শোনেন তাদের নানীর কাছে থেকে সেই ভয়াবহ ১৯৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী। কিভাবে তারা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। মা বোনকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছে । গ্রামের মানুষের হাঁস, মুরগী,ছাগল গরু লুট করে নিয়ে খেয়েছে। আবার কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে নিজ জীবনের ঝুকি নিয়ে তাদের খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করেন, সে দুঃসাহসিক কাহিনী ও তাদের শোনান । তিনি তাদের বলেন ১/২ ঘন্টা বা ১/২ দিনে শুনে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী মনে রাখা যাবেনা। তাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বই এবং বঙ্গবন্ধুর লেখা অসামাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচাসহ অন্যান্য বই পড়ার পরামর্শ দেন ।। জাহানারা বেগমের নাতী-নাতনীদের সহপাঠিরা জাহানারা বেগমের নিকট বায়না ধরে তাদের যেন প্রতি বছর এসে এভাবে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনিয়ে যান।
লোহাগড়া পৌরসভার গোপীনাথপুর গ্রামের সাবেক উপজেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল ইসলাম খান বলেন,সাহসী জাহানারা বেগম মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের আশ্রয় দিয়ে দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে ছিলেন। বর্তমানে তিনি উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বংশ পরম্পরায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে উদ্যোগ গ্রহন করেছেন, এটা একটা অসাধারণ উদ্যোগ। জাহানারা বেগমের মত প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার উচিৎ শিশুদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে এভাবে তুলে ধরা।
উল্লেখ্য, নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার রাজুপুর গ্রামের মৃত পাচু শেখের মেয়ে জাহানারা বেগম ১৯৭১ সালে নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে ২০ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধাদের একমাস আশ্রয় দিয়ে তাদের খাওয়ানো এবং নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করেন। তার এ ত্যাগের কথা মুক্তিযোদ্ধারা আজও ভোলেননি। ইতোমধ্যে জাহানারা বেগমের ২০১৮ সাল থেকে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনানোর বিষয়টি দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং প্রশংসিত হয়েছে।