স্টাফ রিপোর্টার
নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে মোটরসাইকেল উপহার দিয়েছেন প্রখ্যাত নাট্যকার রামেন্দু মজুমদার। নড়াইল শহরের আশ্রম রোডে টিভিএস মোটরসাইকেল এর শো-রুম হতে শনিবার (৪মার্চ) সকালে নাট্যকার রামেন্দু মজুমদারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে মোটরসাইকেলটি হস্তান্তর করেন সৈয়দ আপন আহসান। এসময় উপস্থিত ছিলেন নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ রবিউল ইসলাম, নড়াইল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ নিজাম উদ্দিন খান নিলু, নড়াইল পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমান আরা,এ্যাডভোকেট আব্দুল মুকিত লাবলু, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অনিল কুমার বিশ্বাস,হবখালী ইউপি চেয়ারম্যান টিপু সুলতান,প্রভাষক প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস,প্রভাষক প্রশান্ত সরকার,বিছালী ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান এসএম আনিসুল ইসলাম, টিভিএস বাংলাদেশ মোটরসাইকেল কোম্পানীর কর্মকর্তা পলাশ ঘোষ, টিভিএস’র নড়াইল শো-রুমের মালিক গিয়াস উদ্দিন খান ডালু, ভিপি ইকবাল,এ্যাডভোকেট গাউছুল আজম মাসুম, সাংবাদিক নেতা রিন্টু মুন্সী,সমাজসেবক লিয়াকত হোসেন, কলেজ ছাত্রী শ্যামা বিশ্বাস,টিভিএস নড়াইল শো-রুমের ম্যানেজার রিপন প্রমুখ।
প্রসঙ্গত: গত বছর ১৮ জুন সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিষবাস্প ছড়িয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে পরিকল্পিতভাবে একটি চক্র শারীরিক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত করে এবং তার মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। একই সাথে তিনি সম্মান ও মোটরসাইকেল হারান। এমনকি তাকে চাকুরীচ্যুত করার ঘোষনা দেয়া হয়। পরবর্তীতে কুচক্রী মহলের চক্রান্তের বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানি হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদল তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে কলেজে নিয়ে যান। সম্মান ও চাকুরী ফিরে পেলেও মোটরসাইকেলটি না থাকায় তাঁর চলাচলে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর প্রখ্যাত সাংবাদিক রোবায়েত ফেরদৌস ও সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর রিন্টু’র কাছ থেকে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বাস্তব সমস্যার কথা জেনে তাকে এ মোটরসাইকেলটি উপহার দেন দেশ বরেণ্য নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
মোটরসাইকেল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ বলেন, এ মোটরসাইকেলটি নিছক একটা উপহার নয়, এটা অসামান্য উপহার। এ উপহার প্রমান করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস সেদিন কোন অপরাধ করেননি। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। তিনি একজন সৎ ও ভালো মানুষ। কর্মক্ষেত্রে একজন দক্ষ ও যোগ্য মানুষ। এ উপহার সারা দেশ ও বিশ্ববাসিকে জানিয়ে দিল অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে সবাই ভালোবাসেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তিনি নির্লোভ নির্মোহ একজন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ।
জানা যায়, ২০২২ সালের ১৭ জুন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষের ছাত্র রাহুল দেব রায়’র ফেসবুকে ভারতের নুপুর শর্মা’র ছবি দিয়ে “প্রনাম নিও বস নুপুর শর্মা, জয় শ্রী রাম ” ক্যাপশন দেয়। পরদিন ১৮জুন সকালে বিষয়টি কলেজে জানাজানি হয়। শিক্ষক মন্ডলি ও জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তীর পরামর্শে অত্র কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাস ছাত্র রাহুলকে আটকে পুলিশে দেন।
এরপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ঘটনাটি জিবি’র অন্যান্য সদস্য, পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান,নড়াইল-১ আসনের সাংসদ মোঃ কবিরুল হক মুক্তি সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানান।
মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুরসালিন কলেজ থেকে রাহুলকে নিয়ে যেতে গেলে কতিপয় শিক্ষার্থী বাঁধা দেয়। ইনচার্জ মুরসালিন আরোও পুলিশ এনে তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিছু সময়ের মধ্যে কলেজ চত্বরে বহিরাগতদের আগমন ঘটতে থাকে। একই ভাবে পর্যায়ক্রমে নড়াইল সদর থানার ওসি শওকত কবির ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে ছাত্র রাহুলকে উদ্ধারে ব্যর্থ হওয়ায় বেলা ২টার দিকে পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় ছুটে যান। রাহুলের উপযুক্ত বিচারের আশ্বাস দিয়ে উত্তেজিত জনতা শান্ত করার সর্বাতœক চেষ্টা করেন। ঠিক এমন সময় বহিরাগতদের আক্রমনে পুলিশের সাথে জনগনের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এমনকি ৬ রাউন্ড টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের উপস্থিতিতে ৩ জন হিন্দু শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস,সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অরুন কুমার মন্ডল ও সহকারি অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে ভস্মিভুত করা হয় । শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষকে বেদম মারপিট করে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় বাথরুমে আটকে রাখা হয়।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জুবায়ের হোসেন সহ কয়েকজন ম্যাজিষ্ট্রেট ঘটনাস্থলে যান। তারা উপযুক্ত বিচার দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ছাত্র রাহুল এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে পুলিশ হেফাজতে নেন। পুনরায় নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষনা করা হয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সরেজমিন তদন্তপূর্বক সুস্পষ্ট মতামতের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির পর্যালোচনা এবং মতামত বিশ্লেষনপূর্বক তদন্ত কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এর গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল। কলেজের অধ্যক্ষ’র পদ শুণ্য থাকায় কলেজের কতিপয় শিক্ষকের মধ্যে ওই পদ দখলের প্রতিযোগিতা চলছিল। ছাত্র রাহুলের দেয়া পোষ্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরবর্তিতে বহিরাগতদের আন্দোলনে পরিণত এবং অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেয়া এবং অধ্যক্ষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করার পিছনে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকতে পারে। সংশ্লিষ্টজনের বক্তব্য ও ঘটনার দিনের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আকতার হোসেনের ভূমিকা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
ওই পত্রে একই সাথে ৩টি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, প্রথমত: পত্রজারী হতে ২ মাসের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেনের বিরূদ্ধে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে। তৃতীয়ত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেন (ইনডেক্স নং-৪৩৭৯১২) এর এমপিও কেন বন্ধ করা হবে না, সে বিষয়ে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে অধ্যক্ষ কর্তৃক ব্যাখ্যা এবং সভাপতি কর্তৃক মতামত প্রদান করতে বলা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এর যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট। তবে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের মারধর করার ঘটনা ও মোটরসাইকেলগুলি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষ অদ্যবধি কোন মামলা করেনি। পুলিশের দায়ের করা মামলায় ৫জন গ্রেফতার হয়েছিল। তারা জামিনে আছেন। তবে সুনিশ্চিত অপরাধী সনাক্ত করে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরূদ্ধে কোন শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের মদ্যে অজানা আতংক রয়ে গেছে।