কঙ্কা কণিষ্কা
সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’-শুধু একটি বাক্যের উপর ভিত্তি করেই বিশ্ব রাজনীতিতে হাঁটছেন শেখ হাসিনা। সারা পৃথিবীতে আজ বলা হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষুদ্র কিন্তু সব থেকে কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশেরই। কারণ এই পথের পররাষ্ট্রনীতি চর্চায় ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেন, আজকের পররাষ্ট্রনীতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ।
নামী কূটনীতিকরাও বলছনে এরকম একটি নীতির কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে শেখ হাসিনা হাসিনার অবস্থান এখন শক্ত। এতেই ভাবমূর্তি বাড়ছে বাংলাদেশের। দেশ বিদেশের গণমাধ্যমের উপর ভিত্তি করে, আমরা এযাবৎ বিশ্ব রাজনীতিতে শেখ হাসিনার সাফল্যগুলো দেখে নিতে পারি।
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও একত্রীকরণ নীতি
আঞ্চলিক সহযোগিতা ও একত্রীকরণ নীতিতে এক বড় ধরণের পরিবর্তন এনেছেন শেখ হাসিনা। সন্ত্রাসবাদ, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ দক্ষিণ এশিয়ায় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা মোকাবেলায় এই অঞ্চলের দেশগুলোকে একত্রীকরণের দিকে মনোয্গ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। একাজেই তিনি দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে শীর্ষ নেতৃত্বে চলে এসেছেন। শেখ হাসিনা সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক ফোরামে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক এবং বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন বিমসটেক।
অর্থনৈতিক কূটনীতি
কোন নির্দিষ্ট দেশের প্রতি শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র নীতি দুর্বল নয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যে ভারত, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ এক এক দেশের সাথে একেক রকম পলিসি দিচ্ছে। সক্রিয়ভাবে বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করেছে । টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তথ্যপ্রযুক্তির মতো খাতের সম্প্রসারণের ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শেখ হাসিনার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াবের আমন্ত্রণে ২০১৭ সালের ১৭-২০ জানুয়ারি ফোরামের ৪৭তম বার্ষিক সভায় যোগ দেন শেখ হাসিনা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো নির্বাচিত সরকারপ্রধান এ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হন।
রক্তপাত ছাড়াই রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্প্রসারণ
২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্র সীমার নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ওপর সার্বভৌম অধিকার পায়। এখানে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর কারণে শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হন। পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে এনিয়ে কোন সম্পর্কে কনো রকম বৈরিতা হয়নি। যুদ্ধ ছাড়া এরকম বিশাল সমুদ্ররাশি জয় বিশ্বের ইতিহাসে বিরল,যা সম্ভব হয়ে শেখ হাসিনার দুরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির কারণে।
শান্তিপূর্ণভাবে ছিটমহল বিনিময় পৃথিবীর অনেক বড় রাষ্ট্র না পারলেও বাংলাদেশ পেরেছে। ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেন শেখ হাসিনা, ২০১৫ সালের ১ আগস্ট রাতে ছিটমহলের মানুষ নিজেদের অধিকার, রাষ্ট্র পরিচয় খুঁজে পায়। এতেও দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে এতটুকু ফাটল ধরেনি বরং অনাড়ম্বর আয়োজনের মাধ্যমে এই ছিটমহল বিনিময় হয়েছে।
চীন-ভারত ভারসাম্য রক্ষা
ভারত ও চীনের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থাকলেও শেখ হাসিনার কূটনৈতিক তৎপরতায় দুই দেশের সাথেই বাংলাদেশ নিজের ভালো সম্পর্ক ধরে রেখেছে। এনিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় তাদের ব্যাখ্যায় বলেছে ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটি পুরোপুরি অর্থনৈতিক। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে অভূতপূর্ব সহায়তা করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে ইসলামী জঙ্গিবাদের বিস্তার হয় সেটি যাতে ভারতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে সেজন্যও পদক্ষেপ নিয়েছে হাসিনা সরকার।
২০১৮ সালে ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসাথে মেরিটাইম খাতের সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারত এবং চীন উভয়ের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু একপক্ষকে এ কাজ দেয়া হলে অন্যপক্ষ অখুশি হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকে কোনো পক্ষকেই এ কাজ দেয়া হয়নি। নিঃসন্দেহে এটি শখে হাসিনার বিচক্ষণ পররাষ্ট্রনীতি।
পদ্মাসেতু নির্মাণের সময় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করলেও নিজ দেশের অর্থায়নে সফলতার সাথে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে তাক লাগিয়ে দেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে এই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাথে তাদের ৫০ বছরের সম্পর্ক উদযাপন করছে বেশ আয়োজন করে। শ্রীলংকাকে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে নতুন এক উচ্চতায় বাংলাদেশকে নিয়ে যান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সক্ষমতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে ধরা দেয় এই বিষয়গুলো।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নেতৃত্ব
সম্প্রতি বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে তার অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বরাজনীতি এখন ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সব দেশের প্রায় সব পদক্ষেপই মার্কিন-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই হচ্ছে। এমন অবস্থায় পশ্চিমা বিশ্ব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে তার ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশ নিরাপত্তার বিষয়কে গুরুত্ব দিলেও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার দিকে বেশি আলোকপাত করেছে। কেননা গত দশকে অনেক কঠিন ও কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। জি-২০ সম্মেলনে শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্ব গণমাধ্যমের আকর্ষণ, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে আসা বা রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশে আসা সবকিছুই নতুন এক বার্তা দিচ্ছে।
মানবিক পররাষ্ট্রনীতি
শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতিতে মানবিক বিষয়টিকেও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ,যা সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের একজোট করতেও শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির বিশ্ব ফোরামে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের মুখপাত্র হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। ব্রিটেনের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ড. জেন অ্যালান বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো ব্যক্তি জলবায়ু সম্মেলনের মানবিক প্রতিচ্ছবি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি দেখতে কেমন হয় সেটি তিনি বিশ্ব নেতাদের বোঝাতে পারবেন।”
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনা পাঠায়। বর্তমান সরকারের শাসনামলে পাঠানো সেনার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এর ফলে বিশ্বে যেমন বাংলাদেশের সম্মান বেড়েছে, যেসব সেনা সদস্য ওইসব দেশে যায় তারা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে । কিছুদিন আগেই জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ।
ভ্যাক্সিন কূটনীতি
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষমতার চর্চাকারী কোনো জোটের অন্তর্ভুক্ত হবে না। শেখ হাসিনাও সে পথেই হেঁটেছেন। করোনা মোকাবিলায় ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্যাক্সিন কেনা হয়েছে। কিছু বিনামূল্যে পাওয়া গেছে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে। যার ফলে অত্যন্ত সফলতার সাথে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিকায় সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি কোনো নির্দিষ্ট জোটের অন্তর্ভুক্ত হত তাহলে তার বিপক্ষের দেশগুলো আমাদের ভ্যাক্সিন দিয়ে সাহায্য করত না। এটা শেখ হাসিনার একটি অভূতপূর্ব কূটনৈতিক সাফল্য।
নিজের ভাষাকে অনন্য উচ্চতায় স্থান
শেখ হাসিনার দক্ষ পররাষ্ট্র নীতিতে আলাদা পালক যুক্ত হয় ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে। এটা বাংলা দেশের জন্য, বাংলা ভাষার জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।