বিশেষ প্রতিনিধি
মনিবের কবরে প্রতিদিন কাঁদছে তার পোষা বিড়াল! কথাটি কাল্পনিক মনে হলেও সত্য। এমনই ঘটেছে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর পৌর শহরের ছয়ানিপাড়ার পাড়া মহল্লায় । আর এই ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে সমস্ত উপজেলায়। উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কৌতুল ও স্বচোখে দেখার জন্য ভিড় করছে।
জানা যায়, গত ২৯ এপ্রিল বজ্রপাতে সারাদেশ ব্যাপী মোট ১৬ জন নিহত হয় যা সারাদেশের মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাড়ায়। তার মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলারই ৫ জন নিহত হন, আর শাহজাদপুর উপজেলার নাবিল ও পলিন নামের ২ কিশোর বন্ধু নিহত হয়। নিহত নাবিলের সার্বক্ষণিক সাথি ছিল তারই পোষা বিড়াল টুকি। টুকি কে না খাইয়ে নাবিল খেতোনা, ঘুমোতোও পোষা বিড়ালটিকে নিয়েই।
নাবিলের মৃত্যুর ১২ দিন পরেও প্রতিরাতে ঘুমের সময় হলেই টুকি মনিবের কবরের উপরে গিয়ে অবস্থান নেয়, অনেকেই তার চোখ বেয়ে পানি বের হতে দেখেছে। এবং ঠিক মতো খাওয়ান, যা এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
নাবিল ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট পাগল ছিল। সুযোগ পেলেই ব্যাট-বল হাতে নিয়ে বন্ধুদের সাথে ছুঁটতো খেলার মাঠে। ইচ্ছে ছিল তার বড় হয়ে একদিন দেশ সেরা ক্রিকেটার হওয়ার। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ছোট বেলা থেকেই নাবিল লেখাপড়ার পাশাপাশি মন প্রাণ সঁপে দেয় ক্রিকেটের ভেতরে। ভালো খেলার কারণে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্থানীয় ক্রিকেটাঙ্গণে বেশ নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে নাবিলের।
মেধাকে কাজে লাগিয়ে ক্লাসিক্যাল খেলা উপহার দিয়ে অনেক পুরস্কারও পায় আত্মপ্রত্যয়ী ও পরিশ্রমী নবীন ক্রিকেটার নাবিল। প্রয়াত নাবিলের বাবা অবসরপ্রাপ্ত উদ্ধর্তন ব্যাংক কর্মকর্তা মো: ওমর ফারুক খান কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান,স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) এ ভর্তি হতে চেয়েছিল নাবিল। অনিবার্য কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। শাহজাদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলো নাবিল।
আবাহনীতে ভর্তি হবার জন্য জেলা ছাত্রলীগ নেতা আবাহনীর ক্রিকেটার মারুফ হোসেন সুনামের সাথে যোগাযোগ করে নাবিল। পরবর্তীতে ঢাকায় গিয়ে তার খালাতো ভাই আবাহনী দলের সাবেক খেলোয়াড়, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের কাছের শাওখিক সরকারের
সাথেও যোগাযোগ করেছিলো নাবিল। নাবিলের বাবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আরও বলেন, পরিবারের ছোট ছেলে নাবিল। তার একমাত্র ইচ্ছাই ছিল দেশ সেরা ক্রিকেটার হবার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
নাবিলের স্বপ্ন হারিয়ে গেলো এক নিমিষেই, বজ্রপাতের এক ঝলকেই! বজ্রপাতে নিঃশেষ হয়ে গেলো নাবিলের তরতাজা প্রাণ। সেইসাথে তার স্বপ্নেরও চিরঅবসান ঘটলে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ক্রিকেট নিয়েই মেতেছিল নাবিল। বাড়ি থেকে মাকে বলে বল নিয়ে বের হয়েছিলো। কিন্তু তখন হয়তো নাবিল ভাবতে পারেনি যে, এ খেলাই হবে তার জীবনের শেষ খেলা।
২৯ এপ্রিল বেলা তখন প্রায় ১২ টা! হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ছিটেফোটা পড়ছিলো। সে সময়ে শাহজাদপুর পৌরসদরের শাহজাদপুর থানা ও উপজেলা ভূমি অফিসের দক্ষিণের দুটি পুকুরের মাঝস্থলের পরিত্যাক্ত একটি ভবনের কাছে বন্ধু রিয়াজের সাথে ক্রিকেট নিয়ে গল্প করছিল নাবিল। দশ হাত আদূরে বসে ছিল নাবিলের আরেক বন্ধু পলিন (১৭)।
ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে সেখানে বাজ পড়ায় নাবিল ও তার বন্ধু পলিন গুরুতর আহত হয়। দ্রুত এলাকাবাসী তাদের শংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় নুরজাহান হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তার দ্রুত তাদের পোতাজিয়াস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেররা জরুরী ভিত্তিতে আহতদের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী
মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দিলে এ্যম্বুলেন্সযোগে নাবিল ও পলিনকে সেখানেই নেয়া হয়। ওই হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক আহত নাবিল খান ও পলিনকে পরীক্ষা শেষে মৃত ঘোষণা করে।
নাবিল ও পলিন দু’জনেই শাহজাদপুরের মাওলানা ছাইফ উদ্দিন এহিয়া ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। নাবিলের মা নিভা খান বলেন, ‘আমার ছেলে নাবিল নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতো। সেদিন নাবিল বলল, চুল কাটব মা, সামনে শবে বরাতের রাত। আমি টাকা দিলাম। চুল কাটাতে গিয়ে মাঠে দাঁড়াল খেলা দেখতে। কিন্তু আর ফিরল না।’ এই বলেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিলেন নাড়িছেড়া ধন হারানো নাবিলের মা।
কোলের মানিক সবার আদরের নাবিলকে হারিয়ে ভেঙে গেলো নাবিলের পরিবারের স্বপ্ন। এখনো শোক চলছে সে পরিবারে। নাবিল ও পলিনের অকাল মৃত্যুতে থমকে দাঁড়িয়েছিলো শাহজাদপুর, থমকে দাঁড়িয়েছিলো শাহজাদপুরের মানুষ! করুণ ওই মৃত্যু সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পরিবার, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীসহ চেনা-অচেনা শত শত মানুষ। তাদের মৃত্যুতে পুরো শাহজাদপুরে শোকের ছায়া নেমে এসেছিলো। পরদিন সকালে নামাজে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে নাবিল ও পলিনকে দাফন করা হয়।
এছাড়া, তাদের জন্য বাংলাদেশসহ, সৌদিআরব, শাহজাদপুরের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে, তাদের নিজ এলাকার কলেজ, শাহজাদপুর উপজেলা ছাত্রলীগ, এলাকাবাসী, ঢাকার বিভিন্ন স্থানের মসজিদে মসজিদে তাদের বিদেহি আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া খায়ের ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সপ্তাহ জুড়ে।
নাবিলের মেঝো ভাই তরুণ সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী নিহাল খান বলেন, নাবিল ছিল আমাদের পরিবারের ছোট ছেলে, সবার আদরের।
সে শুধু আমার ছোট ভাইই ছিল না, ভালো বন্ধুও ছিলো। সবে মাত্র ১৭ তে পা দিয়েছিলো সে। অকষ্মাৎ নাবিলের চিরবিদায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না আমরা।
বড় ভাই নাহিন বলেন,দেশসেরা ক্রিকেটার হবার অদম্য ইচ্ছা, নাবিলের লালিত স্বপ্ন সব কিছুই
বজ্রাঘাতে ঝরে পড়ার সাথে সাথে তাকে নিয়ে আমাদের বুকে লালিত অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন চিরবিদায় নিল, শূণ্য বুকটা ভরিয়ে দিয়ে গেলো শুধু কষ্ট, কষ্ট আর কষ্ট দিয়ে।’