নড়াইলের কৃতি সন্তান সৈয়দ নওশের আলীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

5
139
নড়াইলের কৃতি সন্তান সৈয়দ নওশের আলীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নড়াইলের কৃতি সন্তান সৈয়দ নওশের আলী
  • মলয় কান্তি নন্দী
  • সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
  • আব্দুল হাই সিটি কলেজ, নড়াইল

দুই বাংলা, বাংলাদেশ এমনকি জন্মস্থান নড়াইলেও সৈয়দ নওশের আলী একটি বিস্মৃতপ্রায় নাম। পরাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলায় কিংবদন্তীতুল্য রাজনৈতিক নেতা সৈয়দ নওশের আলী এক বৈচিত্রময় ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। ফয়েজ আহমেদ তাঁর ’মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ নামক গ্রন্থে বলেছেন,” নিপীড়িত ও দরিদ্র কৃষকদের অসাধারণ জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। এই নেতা কৃষক সমিতি গঠন করে নড়াইল অঞ্চলে দীর্ঘদিনব্যাপী কৃষকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন।”

কমরেড অমল সেন ’নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা’ নামক পুস্তিকাতে সৈয়দ নওশের আলীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন,” ১৯৪০ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন যশোর জেলার মুসলমান ও নমশুদ্র কৃষকদের মুকুটহীন রাজা।” নড়াইলের তরুনসমাজ তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে অত্যন্ত গর্ববোধ করে, কারণ তারা জানে তাদের আছে এস,এম, সুলতান, বীরশ্রেষ্ঠ নূরমোহাম্মদ, অমল সেন, বিজয় সরকার, উদয়শংকর, রবিশংকর, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, মাশরাফী.. আরো অনেকে। তারা স্পষ্ট ভাবে জানে না গর্ব করার মতো আরো একটি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ রয়েছে তাদের, আর তা হলো একজন মানুষ.. সৈয়দ নওশের আলী যার নাম। কেন নড়াইলের নেতৃস্থানীয় কিছু প্রবীন সৈয়দ নওশের আলীর ইতিহাস সম্পর্কে তরুণদের আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে উদাসীন.. বিষয়টি নিয়ে গবেষণা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, উত্তরপ্রজন্মের সামনে একজন লড়াকু, অসাম্প্রদায়িক, কৃষকবান্ধব রাজনীতিবিদের প্রতিকৃতির উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেয়ার প্রয়াস মাত্র।

সৈয়দ নওশের আলী তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যে পদগুলোতে অধিষ্ঠিত ছিলেন, যে দায়িত্বগুলি তিনি পালন করেছিলেন তা জানলেই তাঁর নেতৃত্বের বিশালতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তিনি কোলকাতা হাইকোর্টের বার এসোসিয়েসনের সভাপতি, ১৯২৫ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত যশোর জেলা বোর্ডের সদস্য, ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ১৯২৯ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত, ১৯৩৭ সালে এ,কে,ফজলুল হকের মন্ত্রীসভায় স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দায়িত্বগ্রহন, ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলার আইনসভার স্পীকার, দেশভাগের পরে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রভিসনাল পার্লামেন্টের সদস্য, ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল এবং ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৮ ভারতের রাজ্যসভার সদস্য ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ও কিছুকাল ভারতীয় কয়লা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে রাজনীতিতে সক্রিয়তা, মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি মনে করতেন হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি এবং ব্রিাটশের হাত থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন বাঙ্গালী মুসলমানদের মুক্তি এনে দিতে পারে।

“Syed Nausher Ali was one of the few political leaders in Bengal who believed that salvation for Bengal Muslims depended on Hindu-Muslim cooperation and in making the country independent of the British.”

প্রখ্যাত এই রাজনীতিক ১৮৯১ সালে তৎকালীন যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার (বর্তমান জেলা) মির্জাপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ ওমেদ আলী এবং মাতার নাম নছিমন নেছা। তিনি পড়াশুনা শুরু করেন নিজ গ্রামের এম,ই স্কুল থেকে। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। গ্রামের স্কুল থেকে এম,ই পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে খুলনার দৌলতপুর হাই স্কুলে (বর্তমান মহসীন হাই স্কুল) ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯০৯ সালে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর দৌলতপুর কলেজে (বর্তমান বি,এল কলেজ) আর্টস নিয়ে লেখাপড়া করেন। এই কলেজে সৈয়দ নওশের আলী ও আটরা গিলাতলা নিবাসী মো: একরামউদ্দীন ই ছিলেন প্রথম মুসলিম ছাত্র।এরপর তিনি কোলকাতা সিটি কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে দর্শন শাস্ত্রে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় এবং পরবর্তীতে আইন পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন।

১৯২২ সালে কোলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর বৈচিত্রময় কর্মজীবনের। শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হকের নেতৃত্ত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টির তিনি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার ফজলুল হক মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেও মাত্র দেড় বছরের মাথায় রাজবন্দীদের মুক্তি ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ প্রশ্নে মতভেদের কারণে ১৯৩৮ সালের ২২ শে জুন মন্ত্রীসভা থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। মন্ত্রী হিসাবে যে স্বল্পকাল তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, তার মধ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কাজ করেছিলেন। সে সময় মুসলমানেরা সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। সৈয়দ নওশের আলী আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক হওয়া সত্বেও অনেক মুসলমান মেডিকেল ছাত্রকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। মেডিকেল কলেজে যেখানে শতকরা ১/২ জন মুসলমান ছাত্র ভর্তি হতে পারতো, সেখানে তিনি এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৪৫ সালের মধ্যে হিন্দু মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা সমান সমান হতে হবে বলে ঘোষনা দেন। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ শূণ্যপদসমূহ তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত লোক দ্বারা পূরণ করেন।

ব্রিটিশ বিরোধী বক্তৃতা করার অপরাধে ১৯৪২ সালে তাকে কারা বরণ করতে হয়েছিল। ১৯৩৯ সালের জুন মাসে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে সৈয়দ নওশের আলী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার স্পীকার নির্বাচিত হন। স্পীকার হিসাবে ১৯৪৫ সালের ২৯ মার্চ যে রুলিং দিয়েছিলেন সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে তা একটি মাইলফলক হিসাবে আজও বিবেচিত হয়ে আসছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টিকে তিনি মেনে নিতে পারেন নাই। তাই তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো পাকিস্তান আমলটাই ভারতে কাটিয়েছেন।” He opted to remain in the West Bengal on the partition of the Sub continent in 1947 as he opposed the Pakistan scheme.”

১৯১৫ সালে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে চার পুত্র ও চার কন্যা জন্ম নেয়। চার পুত্রের নাম যথাক্রমে সৈয়দ মাহমুদ জিলানী, সৈয়দ মনসুর জিলানী, সৈয়দ মাসুদ জিলানী ও সৈয়দ আবু জিলানী রেজা। চার কন্যার নাম যথাক্রমে কানিজ ফাতেমা মাহমুদা, কানিজ ফাতেমা মোহসীনা বেবী, কানিজ ফাতেমা মজিবা রুবি,ও কানিজ ফাতেমা মাসুদা হাওয়া। কানিজ ফাতেমা মোহসীনা বেবীর দুই ছেলে হায়দার আকবর খান রণো ও হায়দার আনোয়ার খান জুনো বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে অতি পরিচিত দুটি নাম।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ০৬ এপ্রিল ৮১ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে এই জননেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় লোকসভার স্পীকার শ্রী জি, এস ধীলন বলেন, ”তিনি ছিলেন সার্থক পার্লামেন্টারিয়ান, স্পীকার হিসাবে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন।” তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ”আলী ছিলেন একজন দক্ষ রাজনৈতিক কর্মী, তাঁর প্রাণশক্তি ও উৎসাহ ছিল অসীম।” সি, পি, আই, এম এর শ্রী সমর মূখার্জী বলেন, “আলী ছিলেন মহান জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা।” তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভা ও রাজ্যসভা উভয় কক্ষেই শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং অধিবেশন একদিনের জন্য মুলতবী হয়।

২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল এই মহান নেতার ৪৩ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে নড়াইল জেলা পাবলিক লাইব্রেরীতে এক আলোচনা সভার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। নড়াইলবাসী এই মাটিতে জন্ম নেয়া সব কৃতি সন্তানকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিতে চায়, এক্ষেত্রে বাধা আসলেও এ প্রজন্ম তা অতিক্রম করার স্পর্ধা লালন করে। সৈয়দ নওশের আলী নড়াইলের মানুষের গর্ব। আমরা সৈয়দ নওশের আলীর গর্বিত উত্তরাধিকার। তথ্যসূত্র:-১। যশোর জেলা পরিষদের শতবর্ষ পূর্তি উৎসবে প্রকাশিত স্মরণিকা, ২। ইন্টারনেট