‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ শকুন সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ ও জনগণের কাছে প্রত্যাশা

230
38
‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ শকুন সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ ও জনগণের কাছে প্রত্যাশা
‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ শকুন সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ ও জনগণের কাছে প্রত্যাশা

দীপংকর বর

কয়েক বছর পূর্বেও মৃত প্রাণীর চারিদিকে নানাধরনের শকুন উড়তে দেখা যেতো। বিভিন্ন কারণে শকুন বিলুপ্তির পথে থাকায় সে দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। মানুষের জন্য ক্ষতিকর আবর্জনা, রোগাক্রান্ত মৃত প্রাণী খেয়ে দুর্গন্ধ ও রোগজীবাণু বাতাসে ছড়াতে না দিয়ে শকুন দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। শকুনের পেটে বিশেষ ধরনের জারক রস থাকায় এটি খাদ্যের সাথে গ্রহণ করা রোগজীবাণু নষ্ট করতে পারে। শকুন না থাকায় গবাদিপশুর মৃতদেহ এখন শিয়াল, কুকুর, ইঁদুর, কাক, চিলসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী খাচ্ছে। এদের পেটে রোগজীবাণু নষ্ট না হওয়ায় জঙ্গল ও জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে এসব মারাত্মক ব্যাধি। শকুন প্রায় বিলুপ্তির পথে থাকায় অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্কসহ পশু হতে সংক্রমিত বিভিন্ন ধরনের রোগের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মুখে রয়েছে মানুষ। তাই, ‘শকুনের অভিশাপে গরু মরে না’ প্রচলিত কথাটি সত্য হলেও শকুনের অভাব মানুষের ক্ষতির কারণ হতে পারে, কথাটি আরো বেশি সত্য।

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির শকুন থাকলেও এদের মধ্যে রাজশকুন বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাশকুন ও সরুঠুটিশকুন আবাসিক শকুন হিসেবে টিকে আছে। বাংলাশকুন বাংলাদেশের একটি প্রতীকী পাখি কারণ বিশ্বব্যাপী পরিচিতির জন্য গৃহীত এর বৈজ্ঞানিক নাম জিপস বেঙ্গালেনসিস এর বেঙ্গালেনসিস শব্দটি বাংলাকে বুঝায়। ‘গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অভ নেচার এর রেড লিস্ট’ এবং ‘রেড লিস্ট অভ বাংলাদেশ-২০১৫’ অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাশকুন মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে। বর্তমানে দেশে বাংলাশকুনের সংখ্যা ২৬০টি, যা গত কয়েক বছর ধরে স্থিতিশীল রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় শকুনের সংখ্যা কমে গেছে ৯৯ শতাংশ এর মতো।

গবাদিপশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডাইক্লোফেনাক’ ও ‘কিটোপ্রফেন’ এর ব্যবহার, নিম্ন জন্মহার, অতিরিক্ত কীটনাশক ও সারের কারণে সৃষ্ট পানিদূষণজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া, খাদ্য সংকট এবং বাসস্থানের প্রচণ্ড সংকট শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। শকুনকে বিলুপ্তির হাত হতে রক্ষা করতে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নাই। এজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার ‘এনডেঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট’ এবং ইংল্যান্ডের ‘হক কনজারভেন্সি ট্রাস্ট’ এর শিকারি পশু বিষয়ক কর্মসূচি শকুন সচেতনতা কার্যক্রমকে একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্টে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়। এবছর আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস উপলক্ষ্যে বন অধিদপ্তর ৪ সেপ্টেম্বর, শনিবার ওয়েবিনারের আয়োজন করবে। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিলুপ্তপ্রায় এ শকুনকে বাঁচাতে গণসচেতনতা বাড়ানোই শকুন সচেতনতা দিবসের মূল উদ্দেশ্য।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার অব্যবহিত পর “বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ (প্রিজারভেশন) অর্ডার ১৯৭৩” প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে কার্যকরী এই আইনের তৃতীয় তফসিলে অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সাথে শকুন শিকার করা, হত্যা করা বা ধরায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২’ জারি করে এর তফসিলেও দেশের বিভিন্ন প্রকার শকুনকে রক্ষিত বন্যপ্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেন। এছাড়া, বর্তমান সরকার বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে জনগণের জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় বিষয়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ১৮(ক) অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন এমপি এর সার্বক্ষণিক দিকনির্দেশনায় বন অধিদপ্তর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শকুনসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গবাদিপশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামের ব্যথানাশক ঔষধের প্রভাবই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ। মৃত পশুর মাংস শকুনের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু ডাইক্লোফেনাক দেওয়া পশুটির মৃত্যু হলেও মৃত পশুর দেহে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়ে যায়। এমন মৃত পশুর মাংস খেলে শকুনের কিডনি নষ্ট হয়ে ২-৩ দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটে। একই ধরনের বিষক্রিয়া দেখা গেছে কিটোপ্রোফেনের বেলাতেও। এজন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে দেশব্যাপী শকুনের জন্য ক্ষতিকারক ওষুধ ‘ডাইক্লোফেনাক’ নিষিদ্ধ করেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে এবছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভায় শকুনের জন্য ক্ষতিকর ঔষধ কিটোপ্রোফেনও নিষিদ্ধ করা হয়, যা বাংলা শকুন রক্ষায় বিশ্বব্যাপী একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, শকুন রক্ষায় কিটোপ্রোফেন জাতীয় ভেটেরিনারি ওষুধের উৎপাদন বন্ধের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। একই সাথে কিটোপ্রোফেন জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধের পরিবর্তে সমান কার্যকর, অথচ শকুনবান্ধব ‘ম্যালোক্সিক্যাম’ নামে একটি ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শও প্রদান করা হয়েছে।

বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের তথ্য মতে, শকুন সংরক্ষণ কার্যক্রম বেগবান করতে ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে সিলেট বিভাগ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ নিয়ে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা-১ এবং খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত নিরাপদ এলাকা-২ গঠন করা হয়েছে। শকুনের নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- শকুনের নিরাপদ এলাকায় ক্ষতিকর ঔষধের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় আনা; শকুনের প্রজননস্থল, বিশ্রামস্থল ও বিচরণ এলাকার বন সংরক্ষণ; মানুষের মধ্যে শকুনের উপর প্রচলিত ভুল ধারণা ও মানুষ-শকুন দ্বন্দ্ব বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো।

দশ বছর (২০১৬-২৫) মেয়াদি ‘বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা’কে অগ্রাধিকার দিয়ে শকুন সংরক্ষণে বর্তমানে সকল ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শকুনের প্রজননকালীন সময়ে বাড়তি খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য ২০১৫ সালে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও সুন্দরবনে দু’টি ফিডিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। অসুস্থ ও আহত শকুনদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১৬ সালে দিনাজপুরের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার ও পরির্চযা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত ১১৫টি হিমালয়ান গৃধিনি প্রজাতির শকুন উদ্ধার, পরিচর্যা শেষে পুনরায় প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়েছে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৭ম ও ৮ম আঞ্চলিক পরিচালনা কমিটি এর সভা আয়োজন করা হয়। উক্ত সভাসমূহে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ও যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ ও বিশেষজ্ঞগণ অংশগ্রহণ করে এবং সভায় শকুন সংরক্ষণে বিভিন্ন কার্যকরী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার শকুন সংরক্ষণের জন্য একটি মাইলফলক।

বনবিভাগ শকুনের আবাসস্থলের দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ ও শকুনের নিরাপদ এলাকার ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে শকুন সংরক্ষণ দল গঠন করেছে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই দলগুলোর সহায়তায় মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। শকুন রক্ষায় হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গা বনাঞ্চলে বন অধিদপ্তর বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বন কর্মীরা শকুনের প্রজনন এলাকায় নিয়মিত টহল দিচ্ছে। রেমা-কালেঙ্গায় ২০১৪ সালে শকুনের প্রজনন সফলতা ছিল ৪৪ শতাংশ, সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে ২০২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট তারিখে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’ এর ১০ম সভাতে শকুনের দু’টি হটস্পট যথা- হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা ও সুন্দরবনে বিদ্যমান শকুনের নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজস্ব খাতের আওতায় বাজেট বরাদ্দ এবং প্রতি দুইবছর অন্তর শকুনের অবস্থা মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বন অধিদপ্তর আইইউসিএনসহ অন্যান্য প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারী সংগঠনের সাথে সমন্বয় করে শকুন সংরক্ষণ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

শুধু সরকারের একার পক্ষে যথাযথভাবে শকুন সংরক্ষণ কষ্টসাধ্য। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিবেদিত ব্যক্তিবর্গসহ পাখিটির বিচরণ এলাকার মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে শকুন রক্ষায় সাফল্য লাভ করা সম্ভব। তাই ‘শকুন’ পাখিটি অনেকের কাছে অজানা কারণে অনাদৃত হলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে মানুষের অভাবনীয় উপকারী ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ অবশিষ্ট শকুনগুলো রক্ষায় আমাদের সকলকে অঙ্গীকার ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। লেখকঃ সিনিয়র তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।