এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান
লোহাগড়া উপজেলার পূর্ব সীমান্তে প্রমত্তা মধুমতি নদী প্রবাহিত। এই নদীর পূর্বতীরে ভাটিয়াপাড়া নামক স্থানে ১৯৩২ সালে নির্মিত ইস্টার্ণ বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানীর কালুখালী থেকে আসা রেল লাইনের সর্বশেষ স্টেশন। এই রেল স্টেশনের অদুরে ছিল একটি অয়্যারলেস টাওয়ার। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার প্রথম বার্তাটি এই অয়্যারলেসের মাধ্যমে লোহাগড়ায় পৌছে ছিল। তখনও ভাটিয়াপাড়ার অয়্যারলেস স্টেশনটি কার্যত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিয়ন্ত্রনে ছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাটিয়াপাড়া অয়্যারলেস স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় পাক আর্মিরা। একশ‘র মত পাক আর্মি অয়্যারলেস স্টেশন ঘিরে গড়ে তোলে মিনি ক্যান্টনমেন্ট। এই মিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পাক আর্মিরা পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের ‘শায়েস্তা’ করতে অভিযান চালাত। ওরা লঞ্চ ও গানবোট নিয়ে মধুমতি নদীর দুইপাড়ের গ্রাম গুলিতে অভিযান চালাত। লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামটি এই মধুমতি নদীর তীরে অবস্থিত। শিক্ষা-সংষ্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে ইতনা একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। লোহাগড়া উপজেলা সদর থেকে গ্রামটির দুরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। আবার ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প থেকেও নদীপথে প্রায় সমান দূরত্ব।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত এবং রাজনীতি সচেতন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সমর্থক। আর এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ইতনা হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। এই ট্রেনিং ক্যাম্পে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ট্রেনিং নিয়েছিল। ভাটিয়াপাড়ায় আর্মি ক্যাম্প হওয়ার আগেই ট্রেনিং ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে ভাটিয়াপাড়ায় পাক আর্মির ক্যাম্প হওয়ার পরই পিস কমিটির দালালরা ইতনায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্প হওয়ার খবর সেখানে পৌছে দেয়। একারণে ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পের পাক আর্মিরা শুরুতেই ইতনার উপর বিশেষ নজর রাখে। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের মত গুরুত্বপূর্ণ খবরটি তাদের নিকটবর্তী ক্যান্টনমেন্টেও জানিয়ে রাখে। ভাটিয়াপাড়ায় পাক সেনাদের শক্ত অবস্থান দেখে তা প্রমানিত হয়েছে। উল্লেখ্য ভাটিয়াপাড়ায় পাকসেনাদের মিনি ক্যান্টনমেন্ট এতটাই নিরাপদ করা হয়েছিল যে সেখানে যুদ্ধবিমান থেকে বোম্বিং করা ছাড়া তাদের গায়ে গুলি লাগানোর কোন সুযোগ ছিল না।
একারণে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার ওই মিনি ক্যান্টনমেন্ট আক্রমন করেও ওদের পরাজিত করতে পারে নাই। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়াজীর আত্মসমর্পণ করার প্রায় সপ্তাহখানেক পর ভাটিয়াপাড়ার পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তা-ও আবার তিন দিন যুদ্ধের পর। ভাটিয়াপাড়ার পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করার কয়েকদিন পর আমি (লেখক) ওই মিনি ক্যান্টনমেন্ট দেখতে গিয়েছিলাম। দেখে মনে হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত একটি স্থায়ী সেনা ছাউনি।
পাক সেনারা তাদের ভাটিয়াপাড়া অবস্থান নিরাপদ করতে প্রথমেই ইতনায় অভিযান চালায়। ইতনা গ্রামে পাকসেনারা প্রথম অভিযান চালায় ১৫ মে ১৯৭১। প্রথমদিনেই ওরা গ্রামের বহু ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া শিকদার হেমায়েতুল ইসলাম ,পেনু ঘোষ ও অতুল পাল নামক তিন জনকে গুলি করে হত্যা করে। ইতনার ন্যায় নদী পাড়ের অন্যন্য গ্রামেও একই কায়দায় অভিযান চালিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ২২ মে পাক সেনারা কাশিয়ানী থানার চরভাটপাড়া গ্রামে অভিযান চালায়। হিন্দু অধ্যুষিত চরভাটপাড়া গ্রামটি ইতনার বিপরীত পাড়ে মধুমতি নদীর তীরে অবস্থিত।
পাক সেনাদের দলটি রণসাজে সজ্জিত হয়ে গ্রামে যাবার সময় নদীর তীরে ওদের গানবোট পাহারা দেবার জন্য একজন সৈনিককে রেখে যায়। গানবোট পাহারাদার সৈনিকটি নদীর পাড়ে এক যুবককে দেখতে পায়। কাপালী সম্প্রদায়ের ওই বাঙ্গালী যুবকটির নাম অনিল কাপালী। অনিল কাপালীকে দেখে পাক সৈনিকটির মনে দুষ্ট বুদ্ধি খেলে। সে অনিলের দিকে রাইফেল তাক করে গুলি করা – গুলি করা খেলতে থাকে। এর আগে পাক সেনারা অনিলের বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে সুঠাম দেহের অধিকারী অনিল কাপালী সুযোগ বুঝে সৈনিকটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে ওর রাইফেলটি কেড়ে নেয়। এরপর কয়েকটি মারধর দিলে চতুর সৈনিকটি অনিলের কাছে হাত জোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চায়। অনিল দয়া দেখিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেও ওর রাইফেলটি নদীতে ফেলে দিয়ে চলে যায়।
এরপর আহত সৈনিকটি খোড়াতে খোড়াতে গিয়ে গ্রামের মধ্যে থাকা ওদের দলনেতা ক্যাপটেনকে এ ঘটনা জানায়। পাক ক্যাপটেন হুইসেল বাজিয়ে সকল সৈনিককে একত্র করে তাদের জানায়। ক্রুদ্ধ পাক ক্যাপটেন অধীনস্ত সৈনিকদের গ্রামে গিয়ে বৃদ্ধ লোকেদের ধরে আনতে নির্দেশ দেয়। বৃদ্ধ গ্রামবাসিরা ঘটনা শুনে পানিতে ফেলে দেয়া রাইফেলটি উদ্ধার করে দিতে এবং অনিল কাপালীকে খুঁজে হাজির করে দিতে রাজী হয়। তবে তারা জীবন বাঁচাতে তাৎক্ষনিক জানায় অনিল কাপালীর বাড়ি ইতনায়। আর যাবে কোথায় । ব্যাটে বলে যেন মিলে গেল। পাক ক্যাপটেন নিশ্চিত হলেন ইতনা তাহলে তো সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম যা তারা আগেই শুনেছিল।
পরদিন ২৩ মে ১৯৭১ সাল। ফজরের আজানের পর পরই ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প থেকে পাকসেনাদের বড় একটি দল ইতনা গ্রামে অভিযান চালায়। ধারণা করা হয় সেদিনের অভিযানের জন্য ওরা ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প ছাড়াও অপর কোন সেনানিবাস থেকে আরো সৈন্য এনেছিল। কারণ ইতনা অভিযানে সৈনিকের সংখ্যা একশ‘র বেশি ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণ। কেউ নামাজরত অবস্থায় কেউবা নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে, আবার কেউবা নামাজ শেষে কোরআন শরীফ পাঠরত ছিলেন। ওদের নির্মম হত্যাকান্ড থেকে কেউই বাদ যায়নি। গুলির শব্দ শুনে ঘুমন্ত গ্রামবাসীরা প্রাণ বাঁচাতে যে যেভাবে পারে পালিয়ে গিয়েছিল। পাকসেনারা এদিনে ইতনা গ্রামে অর্ধশতাধিক লোককে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। গুলি খেয়ে কারো মরতে দেরি হলে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পাক আর্মি আবার অভিযান চালাতে পারে এই ভয়ে সেদিন ইতনা গ্রামে মৃত ব্যক্তিদের জানাজা করা বা তাদের জন্য কবর খোঁড়ার লোকও ছিল না।
এমনকি আপন জনের জন্য মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা কান্নার সুযোগ টুকুও পায়নি। তড়িঘড়ি করে যে যেভাবে পেরেছে মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করেছিল। সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যে অন্যতম একই পরিবারের ৪ সহোদরের হত্যাকান্ড। সৈয়দ শওকত আলী, সৈয়দ এসমত আলী, সৈয়দ কওছার আলী ও সৈয়দ মোশার্রফ আলী নামে এই ৪ সহোদর ছাড়াও এ্ই গ্রামের দক্ষিন পাড়ায় একই সাথে আরও ১০ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে হিমায়েত মিনা ও তারু মিনা নামে আরো দুই সহোদরকে একসাথে গুলি করে হত্যা করা হয়। একাধিক কবর খোঁড়ার লোকের অভাবে এই ৪ সহোদরকে একই কবরে শায়িত করা হয়েছিল। একই ভাবে হিমায়েত মিনাদের দুই ভাইকেও এক কবরে শায়িত করা হয়। সে দৃশ্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মর্মস্পর্শী ও স্মরণীয় ঘটনা। তবে ৪ সহোদরের এই কবরটি আজও গণকবর হিসাবে সংরক্ষণ করা হয় নাই। একইভাবে গণহত্যার শিকার অর্ধশতাধিক গ্রামবাসীও শহীদ হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি।
২৩ মে ১৯৭১ ইতনা গ্রামের মানুষের কাছে আজও একটি স্মরণীয় দিন। সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ হত্যাকান্ড আকস্মিক কোন ঘটনা নয়-এটি সারাদেশে বাঙালী জাতি নিধনের পরিকল্পিত হত্যাকান্ডেরই অংশ। নৃশংস এ হত্যাকান্ডটি একটি যুদ্ধাপরাধ। সেদিনের সে ভয়াবহ হত্যাকান্ড একটি গণহত্যা। পাক সেনারা সেদিন শুধু হত্যাকান্ডই চালায়নি -ওরা সেদিন বহু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে। রেহাই পায়নি গুরুতর অসুস্থ্য বানছারাম মন্ডল নামে এক বৃদ্ধ। ইতনায় গণহত্যার পর গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া গ্রামবাসীদের অনেকেই আর গ্রামে ফিরে আসেনি। দীর্ঘদিন পরে অর্থ্যাৎ ১৯৯৪ সালে ইতনা গণ গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে প্রথমে ইতনা গণহত্যায় শহীদদের তালিকা করে নামফলক স্থাপন করা হয়। পরে অবশ্য জামাল ইউ আহম্মদ নামে এক ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত উদ্যেগে ইতনা চৌরাস্তায় আরো একটি নামফলক স্থাপন করেছে।
নামফলকে লিপিবদ্ধ সেদিনের শহীদরা হলেন, শেখ হাফিজুল ইসলাম হিরু, সৈয়দ শওকত আলী , সৈয়দ এসমত আলী, সৈয়দ কওছার আলী, সৈয়দ মোশার্রফ আলী, শেখ তবিবর রহমান, শিকদার ওয়ালিয়ার রহমান ,শিকদার হাবিবুর রহমান, মোল্যা মকলেসুর রহমান, রাশেদ গাজী, বাদল শেখ, বানছারাম মন্ডল, হারেজ ফকির, তারু মিনা, হিমায়েত মিনা, রবি মোল্যা, আঃ সামাদ মোল্যা, পাচু মিয়া, মতলেব শেখ, নালু খা, শেখ রফিউদ্দিন, নুরুদ্দিন শেখ, কেয়ামদ্দি কিনু ফকির, মির্জা মোবারক হোসেন, নুরু মোল্যা, কুটি মিয়া মোল্যা, কানাই স্বর্ণকার, মোল্যা আবদুর রাজ্জাক, মোল্যা সফিউদ্দিন আহম্মদ, মুনছুর আহমেদ , মালেক শেখ, শিকদার হাদিয়ার রহমান ,নবীর শেখ, ফেলু শেখ, মোহন কাজী, আতিয়ার শেখ, জহুর শেখ, শিকদার ছরোয়ার রহমান ও বাকু শেখ। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই শহীদদের তালিকা না করায় বা এনিয়ে বিশেষ কোন গবেষণা না হওয়ায় সেদিনের সকল শহীদদের নাম তালিকা ভুক্ত হয়নি বলে অনেকের ধারনা। ইতনা গ্রামে এই হত্যাকান্ডের দিনটি ‘ইতনা গণহত্যা দিবস’ হিসাবে বিশেষভাবে পালিত হয়ে আসছে।।
এদিকে গ্রামবাসীরা ‘গ্রাম বাঁচাতে’রাইফেল সহ অনিলকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়। বীর বাঙালী অনিল কাপালীকে পাক সেনারা কয়েকদিন যাবৎ নির্মমভাবে নির্যাতন করে জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করে। লেখা চলবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব)