অন্ধত্ব নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন শিল্পী সুলতানের পালিত কন্যা নিহার বালা

5
5
অন্ধত্ব নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন শিল্পী সুলতানের পালিত কন্যা নিহার বালা
অন্ধত্ব নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন শিল্পী সুলতানের পালিত কন্যা নিহার বালা

শামীমূল ইসলাম 

নড়াইলে শিল্পী সুলতানের বাউন্ডুলে জীবনে ছবি আঁকা থেকে শুরু সমস্ত কাজে একমাত্র সেবিকা হিসেবে তাঁর পালিত কন্যা নিহার বালা দুই দশক অবদান রাখলেও এখন তিনি অন্ধত্ব বরণ করে প্রাণে বেঁচে আছেন। ওষুধ ও সাংসারিক খরচ ঠিকমতো জোগাড় করতে পারছেন না

বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস.এম সুলতানের পালিত কন্যা নিহার বালা ৮ বছর অন্ধত্ববরণ করে প্রাণে বেঁচে আছেন। শিল্পীর খ্যাতিমান হবার সময় দীর্ঘ দুই দশক তিনি আগলে রেখেছিলেন সুলতানকে। নিহারের স্নেহে শিল্পীর বাউল জীবনের অবসান ঘটে। তিনি সুলতানের বাউন্ডুলে জীবনকে নিয়ন্ত্রন করে ছবি আঁকার উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। পরিবারের রান্না-বান্না, পারিবারিক কাজ, শিল্পীর চিড়িয়াখানায় পশু পাখিদের খাওয়ানো ও দেখভাল করেছেন। ঘরে টাকা নেই, রান্না ঘরে চাল নেই, নেই মিনি চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য। চিন্তায় পাগলপ্রায় হয়ে পড়তেন নিহারবালা।

এভাবেই জীবন কেটেছে নিহারবালার। শিল্পীর অসুস্থতায়, দুর্দিনে এবং দৈনন্দিন জীবন যাপনে একমাত্র সেবাময়ী হয়ে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ৮৪ বছর বয়সের এই নারী অর্থভাবে ছানি অপারেশন করতে না পারায় দীর্ঘ ৮ বছর অন্ধত্ব বরণ করেছেন। সরকারিভাবে যে ভাতা পান তার চেয়ে ওষুধ কিনতে খরচ হয় বেশী। অসুস্থ্য ও অন্ধত্বের কারনে চলাফেরা করতে না পারায় বিছানায় অথবা ঘরের এক কোনে সারাক্ষণ শুয়ে-বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

জানা যায়,আনুমানিক ১৯৬৮ সাল থেকে শিল্পী সুলতান শহরের কুড়িগ্রামস্থ জমিদারদের একটি পরিত্যক্ত দ্বিতল জরাজীর্ণ বাড়িতে (বর্তমান সুলতান স্মৃতি
সংগ্রহশালার শিশুস্বর্গ ভবন) থাকতেন। প্রতিবেশী হিসেবে নিহার বালার চানাচুর বিক্রেতা স্বামী হরিপদ সাহার সাথে শিল্পীর ঘনিষ্ট সম্পর্কের সুবাদে নীহার শিল্পী সুলতানকে কাকু বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৭৫ সালের দিকে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর ছোট ছোট দু’মেয়ে নিয়ে আর্থিক অনিশ্চতার জীবন-যাপন করছিলেন নীহার বালা।

এ সময় শিল্পী সুলতান আমশয়সহ নানা মারাত্মক
রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভূগতে থাকলে রোগাক্রান্ত শিল্পীর সেবায় এগিয়ে আসেন নীহার। সেই থেকে নিহার বালা ছোট ভাই দুলাল সাহা এবং শিশু দু’কন্যা
বাসনা ও পদ্মকে নিয়ে শিল্পীর বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে সুলতানের মৃত্যর পর শহরের কুড়িগ্রামে শিল্পীর বাড়িতে গড়ে ওঠা ছোট চিড়িয়াখানাটির পশু পাখি নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা চিড়িয়াখানায়। ২০০৪ সালে শিল্পীর বাড়িতে তৈরী হয় সংগ্রহশালা।

এ সময় বাড়ির সৌন্দর্য রক্ষার খোড়া যুক্তিতে নিহার বালাকে এখান থেকে সরিয়ে সংগ্রহশালা এলাকা সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বে সরকারীভাবে দুই কামরার একটি টিনের ঘর করে দেয়া হয়। সেখানেই জীবন যাপন করছেন শিল্পীর পালিত কন্যা। দুই দশক ধরে শিল্পীর সেবা শুশ্রূষা করলেও নিহার বালার কোনো ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি। সুলতানের শিষ্য নড়াইল সরকারি বালক বিদ্যালয়ের চিত্রাংকন বিভাগের শিক্ষক সমির বৈরাগী বলেন, চিরকুমার শিল্পী সুলতানের পারিবারিক জীবন বলতে ছিল নিহার বালা ও তার দু’কন্যাকে নিয়ে। নিহার বালা পিতৃতূল্যে শিল্পীর সেবা করেছেন, তাকে শাসন করেছেন, ছবি আঁকায় উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং পারিবারিক সমস্ত কাজ দেখাশোনা করেছেন। শিল্পীর খ্যাতিমান হবার পেছনে নিহার বালার অনেক ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

নিহার বালা সাহার নাতি সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার অফিস সহায়ক নয়ন সাহা জানান, দিদা সরকার থেকে ভাতা পান ৫ হাজার টাকা। আমি সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা থেকে পাই ৪ হাজার টাকা । স্ত্রী-পুত্র ও দিদাকে নিয়ে ৪ জনের সংসার। প্রতি মাসে স্বাস কষ্ট, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের জন্য ওষুধের পিছনে খরচ হয় সাড়ে ৬ হাজার টাকার মতো। কয়েকবার তিনি অসুস্থ হলে নড়াইল সদর ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নেওয়া হয়। আগে চিকিৎসার জন্য দিদাকে প্রতিবছর প্রথমে ৩৫ হাজার পরে দু’বার ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হলেও ২০১৪ সাল থেকে তা বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় থেকে গুণি মানুষ হিসেবে ১ লাখ টাকা পান। এছাড়া আর কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। অসুস্থ্য নীহার বালা এ প্রতিনিধিকে জানান, সুলতানের শিশুস্বর্গ বেঁচে থাকুক। সুলতানের স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হোক এটাই আমি চাই। আমার জীবনের শেষ দাবি, আমি যে বাড়িতে বসবাস করছি সেটি আমার নামে লিখে দেওয়া হোক।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, তার অসুস্থতার বিষয়টি শুনেছি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর ডিজি মহোদয়ের সাথে কথা হয়েছে। আগামি ১০ অক্টোবর শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যাপারে কি করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলবো। বরেণ্য এই শিল্পী ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট শহরের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহন করেন এবং ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তাঁর প্রয়াণ ঘটে। রোববার (১০ অক্টোবর) এই শিল্পীর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে।