এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান
কালনা যুদ্ধে বিজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা লোহাগড়া থানা দখলের টার্গেট নেয়। কারণ লোহাগড়া থানা শত্রুমুক্ত না করে ভাটিয়াপাড়ার সেনাঘাঁটি দখল করতে যাওয়া সমীচীন হবে না। কালনায় পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে বিজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। যদিও কালনা যুদ্ধের পরদিন পাক সেনারা একতরফা ভাবে ব্যাপক ধংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়। তারপরও মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। লোহাগড়া থানা তখনও পাক সমর্থিত পুলিশ ও রাজাকারদের দখলে ছিল।
জুলাই-আগস্ট মাস থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দেশে আসতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে শরীফ খসরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর একটি বড় দল লোহাগড়ায় প্রবেশ করে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসতে থাকায় দেশের অভ্যন্তরে থাকা মুক্তিকামী জনতার মনোবল বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহায়তা দিতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে। স্থানীয়ভাবে অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সহযোগি হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। ওইসব গ্রামের সচ্ছল গৃহস্থরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব নেয়। গ্রামের মহিলারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের পরিবারের সদস্যের ন্যায় আপন করে নেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার রান্না ও সরবরাহ করা ছাড়াও পাকসেনা বা রাজাকারদের অবস্থানের খোঁজ-খবর দেয়া ,তাদের গতিবিধির নজর রাখা , মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দেয়াসহ অস্ত্র-গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখার দায়িত্বও তারা পালন করে। এসব মহিলারা যেন আরেক মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ভাগ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী এই শ্রেণির ভুমিকা তেমন গুরুত্ব সহকারে ইতিহাসে স্থান পায়নি।
এমন কি পাকসেনা ও রাজাকারদের দ্বারা ধর্ষিতা মহিলাদের শুধু ‘বীরাঙ্গানা বলেই দায় শোধ’ করা হয়েছিল। তাদের কোন তালিকাও রাখা হয়নি। যদিও সম্প্রতি বীরাঙ্গানাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। লোহাগড়ার দুই বীরাঙ্গানা মহিলাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা একদল মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাড়ির সামনে আমগাছতলায় অবস্থান নেয়।
পায়ে হাঁটা ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্রামে রেখে তাদের দলনেতা লোহাগড়ার দিকে যায়। সম্ভবতঃ তিনি থানার রাজাকার-পুলিশদের অবস্থান রেকি করতে লোহাগড়ার দিকে যান। ওই মুক্তিযোদ্ধাদের একজন লোহাগড়া কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। তার বাড়ি ধলাইতলা গ্রামে হওয়ায় আমি পূর্ব থেকেই তাকে চিনতাম। তিনি আমাকে দেখে কাছে ডেকে নিয়ে বাড়ি থেকে জগ ভরে পানি এনে দিতে বলেন। আমি দ্রুত আমাদের বাড়ি থেকে ওই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জগ ভরে পানি এনে দেই। এমন সময় একখানি যুদ্ধবিমান প্রচন্ড গতিতে আমাদের কাছ দিয়ে উড়ে ভাটিয়াপাড়ার দিকে চলে যায়।
যুদ্ধবিমান উড়ে যেতে দেখে অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে গিয়ে তাদের কাছে থাকা রাইফেল থেকে একটি গুলি ফায়ার হয়ে যায়। তখন আমরা প্রথমে মনে করলাম বোধ হয় যুদ্ধবিমান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে গুলি করেছে। প্রথমে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও বুঝে উঠতে পারে নাই। পরে যার রাইফেল থেকে গুলি ফায়ার হয়েছে সে বলার পরই সকলে নিশ্চিত হয়। ভাগ্য ভালো গুলিটি কারো গায়ে লাগেনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লোহাগড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদী রাজাকারদের বিরুদ্ধে ‘প্রাকৃতিক প্রতিরোধের’ দায়িত্ব পালন করেছে। এই নদীর কারণে লোহাগড়া থানা মুলতঃ দুইভাগে বিভক্ত। নদীটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি বড় ভুমিকা রেখেছে। নবগঙ্গা নদীর কারণে রাজাকার বা পাকসেনারা যখন-তখন ইচ্ছা করলেই গাড়ী ভরে এসে অগ্নিসংযোগ বা লুটপাঠ করে সহজে ফিরে যেতে পারতো না।
নদীতে তখন আজকের মত ব্রীজ ছিল না। এমন কি ভালো কোন ফেরিও ছিল না। পাকসেনারা যত সহজে লক্ষিপাশা পর্যন্ত আসতে পারতো তত সহজে লোহাগড়ার পারে আসতে পারতো না। তখন নবগঙ্গা নদীর লক্ষিপাশার পার রাজাকার পুলিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও লোহাগড়া পারের অধিকাংশ এলাকা মুক্তিযোদ্ধদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বলতে গেলে এ অংশটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ এলাকা ছিল। কালনা যুদ্ধের পর পাক সেনারা দুই-একবার লক্ষিপাশা পর্যন্ত আসলেও নদী পার হয়নি। তখন যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকসেনাদের মাঝে মাঝে লক্ষিপাশার আশপাশে টহল দিতে দেখা গেছে। তখন বড়দিয়া রাস্তা পাকা হয়নি। ফলে জীপ গাড়ী নিয়ে দিঘলিয়ার পরে আর যাওয়ার জন্য তেমন রাস্তাঘাট ছিল না। তবে পাকসেনারা দিঘলিয়া রাস্তা দিয়ে তালবাড়িয়া-কুমড়ি পর্যন্ত গিয়েছে। কুমড়ি স্কুল মাঠে গাড়ী রেখে সেখান থেকে কয়েকটি বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করেছিল।
আর্মি আসার খবর শুনে গ্রামবাসীরা আগেই বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে যায়। পাক সেনদের কাছে ইনফরমেশন ছিল কুমড়ি মুক্তিযোদ্ধার ঘাঁটি। উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কুমড়ি স্কুল মাঠে কয়েকদিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। সম্ভবতঃ সে কারণেই পাকিদের এমন ধারণা হয়েছিল। তবে গ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আগেই পাকসেনারা ফিরে যায়। স্থানীয়দের ধারণা সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় মিলিটারীরা দ্রুত ফিরে যায়। পাক সেনারা লক্ষিপাশার নিকটবর্তী সিংগা গ্রামে হামলা চালিয়ে কয়েকজন গ্রামবাসিকে হত্যা করে এবং কয়েকটি বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে। আর্মি আসার খবর শুনে দৌড়ে পলায়নরত গ্রামবাসিদের উপর মিলিটারীদের এলোপাতাড়ি চালানো গুলিতে এসব গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়।
নভেম্বর মাসের মধ্যে ট্রেনিং নিয়ে দেশে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও বেড়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রামে ছোট ছোট ক্যাম্প করে অবস্থান নেয়। কালনার পুরাতন বাজার ,আড়িয়ারার সিডি স্কুল ,ইতনা স্কুল ও দোয়া মল্লিকপুরে এ ধরনের কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প হয়েছিল। কালনা বাজার ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে কালনায় পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের শক্তিও বেড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বেড়ে যাবার সাথে সাথে থানার পুলিশদের তৎপরতা সীমিত হয়ে যায়। শক্তি বেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের কাছে থানা দখল অনিবার্য হয়ে পড়ে।
লোহাগড়া থানা দখল করতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে থানার রাজাকার-পুলিশদের আত্মসমর্পণের আহবান জানায়। কিন্তু তখন খালেক নামে একজন পুলিশ কনস্টবল আত্মসমর্পণের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়। তখন থানায় তার খুব প্রভাব ছিল। তথাপি পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে অধিকাংশ রাজাকারের মনোবল ভেঙ্গে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আহবানে সাড়া দিয়ে কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। তবে থানার কোন পুলিশ সদস্য আত্নসমর্পণ করে নাই। এ সময় প্রায় প্রতিদিনই রাজাকার পুলিশদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি বিনিময় চলতো। মজার ঘটনা হল মুক্তিযোদ্ধারা একটি গুলি করলে রাজাকাররা অন্ততঃ দশটি গুলি ফোটাতো। এভাবে রাজাকার-পুলিশদের ফাঁদে ফেলে গুলি খরচ করাও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কৌশল ছিল।
দেশের অন্যান্য স্থানেও একইভাবে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমন চালাতে থাকে। লোহাগড়া থানার সীমান্তবর্তী ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্ট আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় পাক সেনাঘাঁটি। বৃহৎ এই শত্রুঘাঁটি ধংস করতে পারলেই কেবল লোহাগড়া থানার মুক্তিযুদ্ধ মোটামুটি সফলতা লাভ করবে। এমন বাস্তবতা মাথায় রেখেই লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ পেলেই বা সংগঠিত হলেই যে যেখানে পেরেছে পাকসেনা বা রাজাকার পুলিশের উপর আক্রমন চালিয়ে ওদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো।
মুক্তিযোদ্ধারা এভাবে একাধিকবার ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্টে হামলা চালিয়েছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝির দিকে লোহাগড়া ও ভাটিয়াপাড়ার মুক্তিযোদ্ধারা মিলে পাকসেনাদের উপর মরণপণ হামলা চালায়। পাকসেনারা বিপদ বুঝে নিকটস্থ যশোর সেনানিবাসে সাহায্য চায়। যশোর থেকে চার খানা জঙ্গী বিমান এসে মেসিন গানের ব্রাস ফায়ার ও বেপরোয়া বোমা বর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা যতবার ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্প আক্রমণ করেছে ততবারই যশোর থেকে জঙ্গী বিমান এসে বোমা বর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তবে ওদের চুড়ান্ত আ/ত্মসমর্পণ করাতে না পারলেও অবাধ চলাফেরা বন্ধ করতে সক্ষম হয়। অক্টোবর মাসের পর ভাটিয়াপাড়ার পাক সেনারা আর বাইরে কোন অপারেশনে যেত না। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা মধুমতি নদী পথে তাদের রসদ আনাও বন্ধ করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের কোথায় কি হচ্ছে সে খবর জানা আজকের মত এত সহজ ছিল না। ঘরে ঘরে রেডিও টেলিভিশন বা মোবাইল ইন্টারনেট ছিল না। তখন পৃথিবীর কোন দেশ আমাদের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলছে বা সাহায্য করছে সে খবর শোনার জন্য সাধারণ মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকত। বিবিসি রেডিও ছিল সঠিক সংবাদের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। বিবিসির মাধ্যমে দেশের অন্যান্য স্থানের যুদ্ধের খবর পাওয়া যেত।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর পাওয়া যেত। তখন আমাদের প্রতিবেশী এক বাড়িতে একটি থ্রি ব্যান্ড রেডিও ছিল। সন্ধ্যায় গ্রামের বয়স্ক লোকেরা যুদ্ধের খবর শোনার জন্য ওই বাড়িতে জড়ো হতো। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিবিসির সান্ধ্যকালীন বাংলা খবর হতো। মুরুব্বীদের সাথে আমিও খবর শুনতে ওই বাড়িতে যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের খবর- বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর শুনতে ভালোই লাগতো। দেশের অন্যান্য জায়গায় বিজয়ের খবর শুনে লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। লেখা চলবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক)