এমএসএ
“২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিতে রাজপথে ভাষা সৈনিকদের সাথে আমিও আন্দোলন সংগ্রামে যোগদান করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্তে লাল হয়ে যায় ঢাকার রাজপথ। মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য রাজপথে নামে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কলেজ পড়ুয়া অসংখ্যা ছাত্র-ছাত্রী। ঢাকা শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই এ আন্দোলন আরো জোরদার হয়। মায়ের ভাষা রক্ষা ও বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সেদিন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকসহ অনেকেই শহীদ হন। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সেই দিন-গুলোর কথা মনে পড়ে যায়”।
ভাষা আন্দোলনের দিনগুলির কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছিলেন প্রয়াত ভাষা সৈনিক নুরুল আলম। ১৯৪৮ সালের জিন্নাহর বক্তব্যের পথ ধরে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বললেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, মেনে নেয়নি বাংলা। ফলশ্রুতিতে ৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ (২১ ফেব্রুয়ারি) তারিখে ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেবার দাবিতে ভাষা সৈনেকেরা আন্দোলন করেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফীউর, অহীউল্লাহ। আহত হয়েছিলেন অনেকে। সেদিন মিছিলে ছিলেন নড়াইল সন্তান ভাষা সৈনিক নুরুল আলম। মিছিলে গুলিবিদ্ধ শফীউর রহমানকে কাঁধে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পথিমধ্যে তাঁর কাঁধে শহীদ হন শফিউর রহমান।
ভাষা সৈনিক নুরুল আলম ১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়ার সরশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের বর্তমান নিবাস সদর উপজেলার ভওয়াখালী গ্রামে। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে আইএসসি পড়তেন। সেসময় থেকেই বড় ভাই শামসুল আলমের সাথে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বড় ভাই ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তাঁর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদের সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন নুরুল আলম। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এসময় তিনি ভাষা আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বড় ভাই শামসুল আলম তাঁকে আন্দোলনে যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “মাকে মা ডাকবো বলে লড়াই করেছিলাম; প্রাণ থাকবে কি থাকবে না সেচিন্তা করার সময় ছিলো না।”
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা শেষে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন শিক্ষার্থীগণ। বিকেল ৩টার সময় চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হন শফীউর। নুরুল আলম ও তার ভাই শফীউরকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। এর মধ্যেই শহীদ হন শফীউর রহমান।
২২ শে ফেব্রুয়ারী মিছিলেও অংশগ্রহণ করেন নুরুল আলম। মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের সামনে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণকাজেও তিনি অংশ নেন। বাংলা ভাষায় একটি সাময়িকী মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা বের করতেন সেখানেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে সরকার সাময়িকীটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য পুলিশের হয়রানিতে মেডিকেল হোস্টেল ছাড়তে বাধ্য হন নুরুল আলম। পূর্বপাকিস্তান ছাত্রইউনিয়নের সক্রিয়কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পলাতক জীবন কাটাতে থাকেন। এসময় চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন মুছে ফেলতে বাধ্য হন। চট্টগাম স্টীল মিলে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ১৯৯২ সালে নিজ এলাকা নড়াইলে ফিরে আসেন তিনি। ভাষা সৈনিকের শেষ জীবন টেটেছে অভাবে ও কষ্টে। কোন স্বীকৃতি, কোন সম্মান, কোন খ্যাতিও পাননি তিনি। তিন ছেলে এক মেয়ের লেখাপড়ার খরচ ও নিজ চিকিৎসা চালাতে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়েছে তাঁর। একপর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় দেশ ও ভাষার প্রতি একবুক ভালোবাসা নিয়ে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি এ পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেন ভাষা সৈনিক নুরুল আলম। যাবার প্রাক্কালে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিকিৎসক হতে পারিনি তাতে দুঃখ নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত”। ভাষার মাসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তাঁর ত্যাগ ও স্মৃতি কথা।