স্টাফ রিপোর্টার
নড়াইলের কালিয়া, নড়াগাতি ও লোহাগড়ার কমপক্ষে ৩০ জন যুবকের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বেসামরিক মালি পদে নকল নিয়োগপত্র প্রদান করে দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি কালিয়া উপজেলার মাউলি ইউনিয়নের কাঠাদুরা গ্রামের মৃত সবর সিকদারের পূত্র রমজান সিকদার( ৫৩)। এলাকার মানুষের অভিযোগ, রমজান ও তার শ্যালক সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার প্রতারণার মাধ্যমে সাধারন মানুষের কাছ থেকে এই বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদিকে দরিদ্র এসব পরিবার চড়া সূদে টাকা নিয়ে এবং শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে রমজানকে দিয়ে চাকরি না পাওয়ায় এখন সর্বশান্ত হয়ে গেছে।
ভূক্তভোগি ও এলাকাবাসী জানান, জেলার নড়াগাতি থানার মাউলি ইউনিয়নের মাউলি গ্রামের কামরুল মুছল্লীর পূত্র সাদিয়ার মুছল্লী (২৩), সুলতান শেখের পূত্র বাপ্পারাজ শেখ, জাহিদুল শেখের পূত্র হুমায়ুন শেখ, অজয় সরকারের পূত্র অনুপ সরকার, বাবু বিশ্বাসের পূত্র নয়ন বিশ্বাস, মনিরুল ইসলামের পূত্র জসিম উদ্দিন, পার্শ্ববর্তী কালিয়া থানার বাবলা-হাসলা ইউনিয়নের ঝিকু শেখের পূত্র আজানুর শেখ, জুলু মোড়লের পূত্র ইমরুল মোড়ল, খুলনা জেলার দাকোপ থানার গড়খালী গ্রামের মিজানুর গাজীর পূত্র তাহের গাজী, গোপালগঞ্জ জেলার চর ধলইতলা গ্রামের আক্কাছ গাজীর পূত্র হীরাংগীর গাজীসহ ১৯জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতারক রমজান ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা নিয়ে সেনাবাহিনীর বেসামরিক মালি পদে নকল নিয়োগপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। নিয়োগপত্রে চাকরি প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে ‘সেনা সদর পূর্ত পরিদপ্তর ঢাকা সেনানিবাস ঢাকা’ লেখা হয়েছে। জানা গেছে, রমজান আরও কমপক্ষে ১০ জনের কাছ থেকে একইভাবে অর্থ নিয়েছে চাকরি দেবার নাম করে। এসব যুবককে নিয়োগপত্র দেবেন বলে একথা সেকথা বলে ঘোরাচ্ছে। গত এক বছর ধরে বিভিন্ন সময় এসব টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দরিদ্র ভ্যান চালক জাহিদুল শেখের পূত্র হুমায়ুন শেখ (২৪) জানায়, ৭ মাস পূর্বে ঢাকার মিরপুরে একটি হোটেলে রমজান, তার শ্যালক সেনাবাহিনীতে কর্মরত ওয়ারেন্ট অফিসার আহাদুজ্জামানসহ তিন জন আমাকে সেনাবাহিনীতে মালি পদের একটি নিয়োগপত্র দেয়। এ সময় তাদের হাতে ৬লাখ টাকা প্রদান করি। নিয়োগপত্রে এ বছরের ১২ মার্চ চাকরিতে যোগদানের কথা থাকলেও রমজান জানায় ১৯ মার্চ যোগদান করতে হবে। তার কথা মতো ১৯ মার্চ মিরপুর সেনানিবাসের সামনে নড়াইলের বিভিন্ন এলাকার ১২জন যুবক যাই। কিন্ত সেখানে আর কাওকে পাওয়া যায়নি। পরে রমজান জানায় কোনো চিন্তা করে না সময়মতো চাকরি পেয়ে যাবে। এখন রমজান এলাকাছাড়া। তার শ্যালক আহাদুজ্জমানের সাথেও আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই। ভ্যান চালক পিতা ৩ লাখ টাকা সুদে এবং ৪০ শতকের একটি জমি বন্দক দিয়ে এ অর্থ সংগ্রহ করেছে বলে জানায়।
শুক্তগ্রামের দরিদ্র জেলে জুলু মোড়ল জানান, পূর্ব সম্পর্কের জের ধরে একই গ্রামের রমজান বলে তোর ছেলেকে সেনাবাহিনীর চাকুরী দিয়ে দেব। তোকে আর কষ্ট করতে হবেনা। তখন নিজের জমি বিক্রি করে এবং এলাকা থেকে সুদে টাকা নিয়ে গত ৮ মাস পূর্বে ৫ লক্ষ টাকা তুলে দেই রমজানের হাতে। বিনিময়ে ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে হোটেলে রেখে একটি নকল নিয়োগপত্র দিয়েছে। জুলু মোড়ল জানান, রমজান তাকে বলেছে বিষয়টি নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করিসনা টাকা ফেরত দিয়ে দিবো। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন জুলু মোড়ল। জানা গেছে, এ প্রতারণার সাথে স্থানীয় মেম্বর খাজা মোল্যাসহ কয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত।
মাউলি গ্রামের সাদিয়ার মুছল্লী (২৫) বলেন, মালি পদে চাকুরী দেওয়ার জন্য রমজান সিকদার তাকেসহ এলাকার আরও ২জনকে একসাথে ঢাকায় মিরপুর নিয়ে একটি হোটেলে রাখে। দিনের বেলা মিরপুর সেনানিবাসের পাশে একটি রেষ্টুরেন্টে নিয়ে চা খেতে দেয় তাদের। পরে সেখানে ২জন লোক এসে তাদেরকে নিয়োগপত্র দেয়। সাদিয়ার নিজের নিয়োগগত্রটি নিয়ে খুশিতে বাড়িতে ফিরে আসি। পরে বাবা মাঠের ৪০শতক জমি বিক্রি ও সুদে লোন নিয়ে রমজান সিকদারকে সাড়ে ৫ লাখ দেওয়া হয়। নিয়োগপত্র নিয়ে চাকুরিতেতে যোগদান করতে গেলে বুঝতে পারি আমাদের সাথে প্রতারনা করেছে রমজান সিকদার।
সাদিয়ারের বাবা কামরুল মুছল্লী বলেন, রমজান সিকদার তার কাছে এসে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার নিজের লোক আছে এবং তার নিজের শ্যালক সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার, চাকুরী দেওয়া তার কাছে সহজ বিষয়। টাকা দিলেই ছেলের চাকুরী হয়ে যাবে। তার কথা মত ছেলেকে একটি সেনাবাহিনীর মালি পদের জন্য ৫ লাখ টাকা দেই। রমজান নকল নিয়োগপত্র দিয়ে এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
একই ইউনিয়নের কলাগাছি গ্রামের এরশাদ শেখ জানান, তার ভাগিনা আবু তাহের গাজী এবং শ্যালক হিরাঙ্গির গাজীকে সেনাবাহিনীর মালি পদে চাকুরী দেওয়ার জন্য ১০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নেয় রমজান। বিনিময়ে তাদের ২ জনকে মালি পদে চাকুরীর ২টি নিয়োগপত্র দেন। নিয়োগ পত্রে লেখা ঠিকানা অনুযায়ী ঢাকা মিরপুর সেনানিবাসে গিলে সেনাবাহিনীর লোকেরা জানিয়ে দেন এই নিয়োগ পত্র নকল। তার পর থেকে প্রতারক রমজানকে বিষয়টি জানালে পুনরায় সঠিক নিয়োগ পত্র দিবেন বলে ঘুরাতে থাকে।
মাউলি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সমাজ কর্মী মোঃ সাবু খান জানান, ১১জন ভূক্তভোগি তাদের নকল নিয়োগপত্র আমার কাছে দিয়ে গেছে এবং তারা এ প্রতারণার বিচার দাবি করেছে। তিনি আরও জানান, ২০০০ সালে রমজান পুলিশের কাছে ১ লাখ টাকার জাল নোট ধরা পড়ে হাজত খাটে। এছাড়া সে জাল দলিলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত। সে অন্যের অর্থ আত্মসাত করে গ্রামে ৪তলা ভিত দিয়ে পাকা বাড়ি করছে।
স্থানীয় মেম্বর খাজা মোল্যা জানান, শুনেছি রমজান অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়েছে। তবে তিনি তার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয় চেয়ারম্যান এস.কে সাজ্জাদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, রমজান চাকরি দেবার কথা বলে ১৯-২০ জনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। এ পর্যন্ত ৭জন আমার কাছে অভিযোগ করেছে যে রমজান চাকরির কথা বলে তাদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৬ টাকা নিয়েছে। রমজান এখন এলাকায় নেই।
রমজান সিকদারের বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী আছিয়া খাতুন জানান, তার স্বামী ঢাকায় গিয়েছে।
রমজানের মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে রমজান সিকদার একটি ভিন্ন মোবাইল দিয়ে ফোন দিয়ে বলে এলাকার লোকেরা তাকে শুধু শুধু ফাসানোর চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে রমজানের শ্যালক আহাদুজ্জামানের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে ফোন করলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
নড়াগাতি থানার ওসি আলমগীর কবির এবং কালিয়া থানার ওসি শেখ শমসের আলী জানান, এ বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। যদি কেউ লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।