নিজস্ব প্রতিবেদক
‘সকালে যেহানে রান্না করে খালাম, দুপুরে গেল নদীর প্যাটে। অবস্থা বেগতিক দেহে (দেখে) রাত ১২টার দিকে নিজেরাই ঘর ভাঙা শুরু করলাম। এই ভাঙনে নারকেল গাছ, আমগাছ, কাঁঠাল গাছসহ সবকিছু নদীর মধ্যে চলে গেছে। আর বসতভিটার ৫ শতক জমিও এহন (এখন) নদীর প্যাটে।’ কথাগুলো বলছিলেন নবগঙ্গা নদী ভাঙনে নিঃস্ব নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শুক্ত গ্রামস্থ গুচ্ছ গ্রামের মনি মোল্যার স্ত্রী গোলজান বেগম (৫৪)। গোলজানদের বাড়ি আগে ছিল নদীর ওপারে; গ্রামটি নদীতে বিলীন হওয়ার পর গুচ্ছগ্রামে এসে বাড়ি করেন। সেখানেও ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন তারা। এভাবেই নবগঙ্গা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে কালিয়া উপজেলার শুক্ত গ্রামস্থ গুচ্ছ গ্রামের অর্ধেকটা। গত দুই মাস যাবত ভা্গংনে নবঙ্গার নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে হাচলা সহ শুক্ত গ্রাম। গ্রাম দুইটি জেলার মানচিত্রে থাকলেও তার অর্ধেকটা আর দৃশ্যমান নেই। গত ৫ দিনের মধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে এ এলাকার ৩০টি বসতভিটা, বাড়িঘর ও বহু গাছপালা। তবুও ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাচলা শুক্ত গ্রামের অর্ধেকের বেশি নবঙ্গা নদী গর্ভে চলে গেছে। সকলের সাথে সকলে মিলে মিশে টিনের ঘরগুলো খুলে নিচ্ছে তারা। ফাঁকা জায়গায় পড়ে আছে ধানের গোলা, মাইঠ (ধান বা শস্য রাখার মাটির পাত্র বিশেষ), ভাঙাচেরা আসবাবপত্রসহ গাছপালা। আর খুপড়ি রান্নাঘরটি দাঁড়িয়ে আছে বসতভিটার এককোণে। এক বাড়ির গৃহকর্ত্রী হামিদা বেগম (৫৫) বলেন, ‘চুরি করে নিলেও ঘরবাড়ি থাহে, আগুনে পুড়লেও পোতা (ভিটেমাটি) থাহে; কিন্তু নদীতে ভাঙলে কিছুই থাহে না। নদীর কাজ নদী করে যাচ্ছে, দিনরাত ভাঙ্গে যাচ্ছে। ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা নেই।’ তিনি আরো বলেন, নদী ভাঙনে বাড়িঘর হারানোর ভয় ও চিন্তায় আমার স্বামী গত কোরবানির ঈদের এক সপ্তাহ পর ব্রেনস্টোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমার সংসারে দুই ছেলে এবং চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা কোথায় যাবো? আপাঃতত বাগানের মধ্যে ঘর উঠিয়ে কোনো ভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছি। চাঁন মিয়া মোল্যা বলেন, অনেক পরিবার সাতবার পর্যন্ত বাড়িঘর সরিয়েও রক্ষা পায়নি, গ্রাস করেছে নবগঙ্গা নদী। তবুও পাউবো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ভাঙনরোধে এই এলাকায় এক ইঞ্চি কাজও করেনি।
শুক্তগ্রাম বাজার কমিটির সাধারন লোকজন বলেন, এ এলাকায় বন্যা নেই। তবে, ভাঙনের কারণে শত শত মানুষকে যেখানে-সেখানে থাকতে হচ্ছে। শুক্তগ্রাম বাজারকে নবগঙ্গার ভাংগন থেকে রক্ষা করার জন্য সেচ্ছাশ্রমে বাজারের দোকানদারগন বস্তায বালু ভরে নিজেদেও উদ্যোগে বাজার রক্ষা বাধ করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ গ্রহন করে নাই।গুচ্ছ গ্রামের নান্নু মোল্যার স্ত্রী মাছুরা বেগম বলেন, নদী ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে আমার দেড় বছরের শিশুকে নিয়ে রোদ, বৃষ্টিতে অনেক কষ্টে আছি। আমরা কিছু চাই না, সরকার আমাদের নদী ভাঙন ঠেকিয়ে দিক, একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিক। হামিদুল শেখ বলেন, তিনবার নদী ভাঙনে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার আমাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। এখন পরের বাড়ি থাকি, কৃষি কাজ করি। মগরেব মোল্যা বলেন, আমার বাড়ি সাতবার ভেঙে গেছে। এবার কোথায় ঈদ নামাজ পড়ব, কী করব? এবার এলাকাবাসীর মনে ঈদ আনন্দ নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একটা গ্রাম নদীতে চলে যাচ্ছে, অথচ সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তোরাপ মোল্যা বলেন, পাঁচবার বাড়িঘর সরানো হয়েছে। খুব অসহায় অবস্থায় আছি। সরকারের কাছে আমাদের-একটাই দাবি, পাথর দিয়ে নদীটা যেন বেঁধে দেয়। গত দুই মাস নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, পাশাপাশি এ এলাকার মানুষকে পুনর্বাসন এবং আর্থিক ও খাদ্য সহযোগিতা করা হয়নি। এছাড়া ভাঙনের তীব্রতায় এ এলাকার বিদ্যুৎ এবং ডিশ লাইনও খুলে ফেলেছেন ভূক্তভোগীরা। এ পরিস্থিতিতে নিদারুণ কষ্ট ও ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন সবাই।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানেওয়াজ তালুকদার বলেন, সাংবাদিকদের মাধ্যমে খবর পেয়ে শুক্ত গ্রামের ভাঙন কবলিত অংশ পরিদর্শন করেছি। ওই এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। এজন্য কিছু ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হয়েছে। বিষয়টি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। প্রয়োজনীয় বাজেট পেলে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।