এমএসএ
আজ ১০ জানুয়ারি, ২০১৯ বৃহস্পতিবার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এদিন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান। এরপর দিল্লী থেকে নিজ মাতৃভূমি বাংলার মাটিতে পা রাখেন। সেদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে সংবর্ধনা জানান। বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। তিনি সশ্রদ্ধ চিত্তে সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন,
“আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু, মুসলমানকে (যাদের) হত্যা করা হয়েছে আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে আমি আপনাদের দু-এককথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা দিতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে৷ আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবেই। আমি আমার সেই যেই ভাইয়েরা আত্মাহুতি দিয়েছে, শহীদ হয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আজ প্রায় ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলা হয়েছে বাংলায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও, প্রথম মহাযুদ্ধেও এত মানুষ, এত সাধারণ নাগরিক মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই যা আমার ৭ কোটির বাংলাদেশে হয়েছে।
আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসবো। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙ্গালির কাছে দিয়ে দিও– এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে আমি করছি।”
এরপর বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের সাধারণ মানুষ ও সামরিক বাহিনী, রাশিয়ার জনসাধারণ; ব্রিটিশ, জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের জনগণ যারা বাংলদেশকে সমর্থন জানিয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও মোবারক জানান। আমেরিকার জনসাধারণদের তিনি মোবারকবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, “মোবারকবাদ জানাই সারা বিশ্বের মজলুম জনগণকে যারা আমার এই মুক্ত সংগ্রামকে সাহায্য করেছে।” এরপর এক কোটি বাঙ্গালীকে আশ্রয়, আহার দেয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারকে তিনি বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
বাঙ্গালী জাতির জনক উল্লেখ করেন, “তবে মনে রাখা উচিৎ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দামাতে পারবে না। বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই৷ আমি যাবার আগে বলেছিলাম, ও বাঙ্গালী এবারে তোমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। তোমরা তা করেছ…আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, আমার বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখবো না। আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়া অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই।
আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।”
ভাষণে বঙ্গবন্ধু সকল রাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার জন্য সাহায্য আবেদন করেন। তিনি বলেন, “আমার বাংলাদেশকে তোমরা সাহায্য কর। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও। দিতে হবে, উপায় নাই, দিতে হবে। আমরা হার মানবো না। আমরা হার মানতে জানি না।”
বাঙালী জাতি প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙ্গালীর হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালী আজ মানুষ। আমার বাঙালী আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতার সংগ্রামে এত লোক আত্মহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় (বাঙালীদের) দাবায় রাখতে পারবে না।”
জাতির জনক সকলকে অনুরোধ ও আদেশ দিয়ে বলেন, “নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়- (আজ থেকে) আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই।”
স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষায় তিনি বলেন, “এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়; এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার মা বোনেরা কাপড় না পায়, যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি বা কাজ না পায়।”
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও অবদানের জন্য মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কর্মী বাহিনীদের প্রতি বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আজ থেকে বাংলায় যেন কোন চুরি ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আজ লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা আছে অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক বাংলায় কথা বলে না, আজ বলছি তোমরা বাঙালী হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি তাদের উপর তোমরা হাত তুলো না। আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি।
তবে যারা দালালী করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন। একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে, স্বাধীন নাগরিকের মত স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালী রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালী শান্তি বজায় রাখতেও জানে।
জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙ্গালী, আমি মানুষ, আমি মোসলমান- একবার মরে ২ বার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো। আমার বাঙ্গালী জাতকে অপমান করা যাবে না। তোমাদের (পাকিস্তানি) কাছে ক্ষমা চাইবো না। এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালী আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান…
পূর্ণ ভাষণঃ https://youtu.be/Qfc5l76i5f0