নিজ ডেস্ক
২২ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক দিন। ছাত্রজনতার আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানী স্বৈরশাসক ১৯৬৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং সভায় তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। শনিবার ২৩শে ফেব্রুয়ারী সকাল ১০টায় রাজধানীর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরে কবি বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু দিবস পালন ও ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির ৫০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে সম্মাননা প্রদান করে ৭১ ফাউন্ডেশন।
এসময় নড়াইল জেলার কৃতি সন্তান লে: এম এম মতিউর রহমানের পক্ষে সন্মাননা গ্রহন করেন লে:এম,এম মতিউর রহমানের ছোট ছেলে এম এম সুজন রহমান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বর্তমান এমপি তোফায়েল আহমেদসহ অন্যান্য এমপিগণ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি জীবিত কর্নেল শওকত” স্টুয়ার্ট মুজিব” সার্জেন্ট আব্দুল জলিল সহ অন্য দুজন ও পরিবার পরিজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার মধুমতি তীরবর্তী মাকড়াইল গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১ ডিসেম্বর লেঃ এম,এম মতিউর রহমান জন্মগ্রহন করেন। লে:এম,এম মতিউর রহমানের পিতা সুলাইমান মোল্লা গ্রামের প্রভাবশালী মাতুব্বর ছিলেন। মতিউর রহমানের গ্রামের মক্তবে লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়। এলাকায় ভালো স্কুল না থাকায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত মাগুরার একটি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। অংক বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল। জোকার ওস্তাদজী ইউসুফ মিয়ার তত্বাবধানে গণিত শাস্ত্রের উপর দুর্বলতা কেটে উঠে। অংকে লেটার নম্বরসহ কৃতিত্বের সাথে লাহুড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক পাস করেন। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে গণিত শাস্ত্রেই এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হতে বিএড ডিগ্রি লাভের পর ১৯৬১ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর এডুকেশন কোরে এসিসট্যান্ট লেফটেন্যান্ট পদে চাকুরীতে প্রবেশ করেন। ঐবছরই তিনি কানিজ ফাতেমা রওশন আকতার পপিকে বিয়ে করেন। শ্বশুর মাজহার উদ্দীন উচ্চ শিক্ষিত এবং জেলা শিক্ষা অফিসার মাস্টার ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে মিটিং মিছিলে যোগদান করতেন।
১৯৫৪ সালের সাধারন নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেছেন। মাকড়াইল গ্রামসহ শালনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুসলিমলীগ পন্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামানের সমর্থক। দোর্দন্ড প্রতাপশালী পিতাও সেই পক্ষের ছিলেন। এরূপ প্রতিকূল পরিবেশে তিনি কাজ করেছন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের এ্যডঃ আবুল খালেক বিপুল ভোটে বিজয়ী হন এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদ লাভ করেছিলেন। মতিউর রহমান ছিলেন ধীর স্থির, অমায়িক ব্যবহার এবং সচ্চরিত্রেরর অধিকারী। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল প্রবল। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বি,এস,সি পড়ার সময় বিপুল ভোটে ছাত্র সংসদের ভি,পি নির্বাচিত হয়েছিলেন মতিউর রহমান। করাচিতে চাকরি করাকালীন পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক আচরনে বিক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী কতৃক সংখাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর শোষণ, নির্যাতন, বৈষম্য, ও প্রভুসুলভ আচরণে তার বিদ্রোহী মন সোচ্চার হয়ে ওঠে। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী এটা ভালো চোখে দেখেনি।
১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সি এস পি মোঃ রুহুল কুদ্দুস, লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমূখের সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীহন মতিউর রহমান। তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দী করা হয়। এদিকে চলে বিচারের নামে প্রহসন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্র মামলার অবসান ঘটে। মুক্তি লাভ করে বাঙলার সূর্য সন্তানেরা। দেশবাসী দেয় বীরোচিত সংবর্ধনা। ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এম সি এ নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই তিনি বেশ কয়েকটি স্থানে ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছিলেন। নড়াইল ট্রেজারিলুট সহ যশোর ক্যন্টনমেন্ট আক্রমনের নেতৃত্ব দেন মতিউর রহমান। অতঃপর ভারতে গমন করে বনগাঁর টালিখোলা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যশোর ফরিদপুর অঞ্চলের যুবকদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা নেন।একজন সৎ নিবেদিত প্রান হিসেবে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু তাকে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনের গুরু দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি রেডক্রসেরর পরিচালক, পরে কনজুমার্স সাপ্লাই ও টি,সি,বির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তার জীবনে নেমে আসে ঝড়। নীতির সাথে আপোষ করতে না পারায় শেষ জীবন কাটে চরম মানবেতর। জীবিকার জন্য মতিউর রহমান ফিরে আসেন আইনপেশায়। শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। আক্রান্ত হন জটিল ব্রেন টিউমার রোগে। বাবার ভিটে, স্ত্রীর গয়না সহ সর্বস্ব ব্যয় করেন চিকিৎসার পেছনে।সহযোগিতার হাত কেউ প্রসারিত করেনি। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু মানসিক যন্ত্রনা, দারিদ্র্য ও দুরারোগ্য ব্যাধির সাথে লড়তে লড়তে ১৯৮০ সালের ২০ শে মে জীবন যুদ্ধে হার মেনে নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। ছিলেন নির্লোভ, সৎ ও খাঁটি দেশপ্রেমিক। চাকুরিসুবাদে হতে পারতেন কোটি পতি। কিন্তু সততা ও নির্লোভ অহংকারের কাছে হার হয়েছে দুর্নীতির।তার মৃত্যুর পর লোহাগড়ায় তেমন কোনো গতিশীল নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেনি।