অভিজিৎ কর্মকার
“ভাষার সাথে নদীস্রোতের একটি অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। নদীস্রোতের মতোই ভাষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের বাঁক সৃষ্টি করে চলে”। ভাষার পরিবর্তন মানে সচেতনভাবে ভাষার বিকৃতি নয়। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, চলমান নদীর গতিস্রোত থেমে গেলে একসময় সেই নদীটি মরে যায়। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে, কালের বিবর্তনে আমরা অনেক নদীর অপমৃত্যু হতে দেখেছি।
নদীর মৃত্যুতে আমরা বিচলিত নই, বরং আনন্দিত। আমরা যারা আত্নঘাতী, তারা ভাষার মৃত্যুতেও কাঁদবো না। বাংলা ভাষার বিকৃতিতে আমরা ব্যথিত হবো না। বিমল আনন্দ পাওয়ার জন্য যে যার মতো বানানরীতি চালু করবো। আমরা আর আমড়া শব্দের মধ্য কোন পার্থক্য থাকবে না। বাংলা বানান ভুল করার জন্য বানান ভুলকারীকে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে পুরষ্কৃত করা হবে।
ভাষার মৃত্যু প্রসঙ্গটি অনেকের কাছে অমূলক মনে হতে পারে। কিন্তু একটি দেশের সচেতেন ও শিক্ষিত মানুষ দ্বারা, সচেতনভাবে একটি ভাষার অশুদ্ধ প্রয়োগ ও ব্যবহার হতে থাকলে, সেই ভাষাটি কালক্রমে মরে যেতে পারে। এমনটি ধারণা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের অতীত প্রজন্ম ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। রাজপথে সংগ্রাম করেছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই সূত্রপাত ঘটেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। অথচ, স্বাধীন বাংলাদেশে হরদম চলছে প্রিয় বাংলা ভাষার বিকৃতি।
একটি ভাষার মৃত্যু মানে একটি জাতির মৃত্যু। একটি ভাষার মৃত্যু মানে সেই ভাষিক সম্প্রদায়ের চিন্তা ও চেতনার মৃত্যু। মৃত্যুকূপ এই দেশে মানুষের মৃত্যু কোন শোকের ব্যাপার না হলেও ভাষার অপপ্রয়োগ ও ব্যবহার কিন্তু এ জাতির জন্য উদ্বেগ ও লজ্জাজনক। কারণ পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। অতএব, বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। ভাষার বিকৃতি নিয়ে যারা খোঁড়া যুক্তি দেখায়, কিংবা এই বিষয়টিকে যারা হালকা ভাবে দেখে, তারা বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী। একজন মানুষের ভাষিক দক্ষতা তার শিক্ষাগত যোগ্যতা মূল্যয়নের বড় মাপকাঠি।
আমরা অনেকেই ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকানদের মতো ইংরেজী উচ্চারণ করতে পারাটাকে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার চেয়েও গর্বের বিষয় মনে করি। স্বাধীন বাংলাদেশে আজো অনেকের নিজ ভাষায় কথা বলার ধরণ দেখে মনে হয়, ইংরেজদের দাসত্ব আমরা এখনও ভুলিনি।