মোহাম্মদ শওকত আলী
মহান আল্লাহ সূরা আদ-দুখানের ৩ নং আয়াতে বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি এ কুরআনকে এক বরকতময় রাতে নাযিল করেছি।” একই সূরার ৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “এ রাতেই প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয় (অর্থাৎ ফয়সালা হয়)।” কেউ কেউ দাবী করে থাকেন যে, ৩ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বা ‘বরকতময় রাত’ বলতে শবে বরাতকেই বোঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে তারা তাফসীরে ইবনে কাসীর, কুরতুবী, ইত্যাদির উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। অথচ তাফসীর গ্রন্থগুলো আসলে কী বলেছে, তা আমরা পড়েও দেখতে চাই না। ইমাম ইবনে কাসীর (রাহঃ) বলেনঃ সূরা আদ-দুখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বা ‘বরকতময় রাত’ বলতে লাইলাতুল ক্বদর-কে বোঝানো হয়েছে। কারণ, এখানে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে। আর সূরা ক্বদর-এর প্রথম আয়াতে স্পষ্ট করেই বলা আছে যে, কুরআন লাইলাতুল ক্বদর-এ নাযিল হয়েছে। তাছাড়া, সূরা বাক্বারার ১৮৫ নং আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কুরআন নাযিল হয়েছে রমজান মাসে। কুরআন নাযিলের রাতটিকে কোনভাবেই রমজান মাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, “নিশ্চয়ই আমি এ কুরআনকে এক বরকতময় রাতে নাযিল করেছি।” – সূরা আদ-দুখানের এ আয়াতটি দ্বারা শবে বরাতকে ইঙ্গিত করা হয় নি, বরং শবে ক্বদর বা লাইলাতুল ক্বদরকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
যারা কুরআনের এই অকাট্ট বিষয়টির উদ্ধৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে অসতর্ক, তারা হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন, তা আল্লাহ-ই ভাল জানেন।
এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই। তাছাড়া, বুখারী ও মুসলিম—এ দুটো হাদিস গ্রন্থের কোনটিতেই শবে বরাত সম্পর্কে কোন একটি হাদিসও নেই। অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত সবগুলো হাদিসের সনদের মধ্যে দুর্বলতা বিদ্যমান থাকার কারণে একটি হাদিসও সহীহ’র মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। বরং সবগুলোই যইফ (দুর্বল)। তবে, মউজু (অর্থাৎ জাল বা বানোয়াট) নয়।
অবশ্য, দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতেও শবে বরাতের আমল করা যেতে পারে বলে অনেক ওলামায়ে কেরাম মতামত দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমল করতে চাইলে কিভাবে করা উচিত। এ সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মনে রখা প্রয়োজনঃ
১। হায়াত, মউত, রিযক, ইত্যাদির ফয়সালা এ রাতে হয়–এমন বিশ্বাস রাখা যাবে না। কারণ, এসব ফয়সালা যে লাইলাতুল ক্বদরে হয়, তা সুস্পষ্টভাবে কুরআন ও সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণীত।
২। ব্যক্তিগতভাবে কিছু ইবাদত-বন্দেগী করা যেতে পারে। মসজিদে সমবেত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার জন্য ওয়াজ-নসীহত, যিকির, ইত্যাদি আয়োজন করার প্রয়োজন নেই। (দেখুনঃ ফাতাওয়া শামীয়া, ইমাম বিন আবেদীন, পৃষ্ঠা ৬৪২)। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কিরামগণ এমনটি করেননি। তাই সে ত্বরিকার বাইরে ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতা আবিষ্কার না করাই শ্রেয়।
৩। নফল ইবাদতের জন্য সারা রাত মসজিদে গিয়ে জেগে থাকা রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নত বিরোধী। তিনি নফল ইবাদত ঘরে এবং ফরয ইবাদত জামা’আতের সাথে মসজিদে আদায় করার জন্য তা’কীদ করেছেন।
৪। সারা রাত জেগে থেকে ইবাদত করাটাও সুন্নত বিরোধী। প্রিয় নবীজী (সাঃ) সব রাতেই কিছু অংশ ইবাদত করতেন, আর কিছু অংশ ঘুমাতেন। তাঁর জীবনে এমন কোন রাতের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়না, যাতে তিনি একটুও না ঘুমিয়ে সারা রাত জেগে ইবাদত করেছেন।
৫। শবে বরাতের রোযার পক্ষে যেহেতু কোন মজবুত দলিল নেই, তাই যারা নফল রোযা রাখতে চান, তারা ১৩, ১৪ ও ১৫ শা’বান আইয়ামে বীজের তিনটি রোযা রাখতে পারেন। এর পক্ষে সহীহ হাদিসের দলিল রয়েছে। শুধু একটি না রেখে এ তিনটি বা তার চেয়েও বেশী রোযা রাখতে পারলে আরও ভাল। কারণ, শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবচেয়ে বেশী পরিমাণ নফল রোযা রেখেছেন।
৬। আমাদের দেশে (বাংলাদেশে) আলোকসজ্জা ও আতশবজির যে তামাশা করা হয়, তা প্রকাশ্য বিদ’আত। সে ধারণা থেকে কোন এলাকায় এ রাতের নাম হচ্ছে বাতির রাত। এ সব ধারণা হিন্দুদের দিওয়ালী অনুষ্ঠান থেকে ইসলামী শরীয়তে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রাহঃ)। হালুয়া-রুটি বিলি-বণ্টনের কার্যক্রমও বিদ’আত। (দেখুনঃ ফাতাওয়া শামীয়া, ইমাম বিন আবেদীন, পৃষ্ঠা ৬৪২)।
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিসের উপর আমল করার তাওফীক দান করুণ। আমীন। (সূত্রঃ ইষ্ট লন্ডন মসজিদ-এর সম্মানিত খতিব শায়খ মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম-এর একটি খুতবার উপর ভিত্তি করে লিখিত।)