অভিজিৎ কর্মকার
ধর্ষণ, ধর্ষক ও ধর্ষিতা/ধর্ষিত; চারটা শব্দই সারা পৃথিবীতে বহুল আলোচিত ও উচ্চারিত শব্দ। তবে আমাদের দেশে মাঝে মাঝে উপর্যুক্ত চারটা শব্দ সারা পৃথিবীকে পেছনে ফেলে এককভাবে আলোচনার সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়। সকলের মুখে কম বেশি উচ্চারিত হয় ধর্ষণ, ধর্ষক ও ধর্ষিত/ধর্ষিতা। ধর্ষক মানে পরক্রমশালী বীর, ধর্ষিতা/ধর্ষিত মানেই দুর্বল আপাক্তেয়। ধর্ষণের কথা শুনলে এদেশে কারো কারো চোখ অন্ধকারে হীরক খন্ডের মতে চিকচিক করে উঠে। খোঁড়া যুক্তি দিয়ে কেউ কেউ ধর্ষণকে জাস্টিফাইড করার চেষ্টা করেন, কেউ কেউ আবার ধর্ষণ করতে না পারার জন্য আক্ষেপ করেন, কেউ ধর্ষিত/ধর্ষিতার দিকে আঙুল তুলে বেকুসর খালাস দেন পরক্রমশালী বীর নিপীড়ক নরপশু ধর্ষককে। ধর্ষণ সারা পৃথিবীর যে কোন সভ্য মানুষের কাছে নিকৃষ্ট একটি অপরাধ। এই নিকৃষ্ট অপরাধটি সংঘঠিত করে ধর্ষক তার শিশ্ন দিয়ে। ধর্ষক শব্দটির দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, ধর্ষক শব্দটি পুরুষবাচক একটি শব্দ। যার কোন স্ত্রী বাচক শব্দ নেই। কেননা, পুরুষই নিকৃষ্ট অপরাধ ধর্ষণ করার ক্ষমতাবান। তবে ধর্ষণ নারীর দ্বারাও হতে পারে। ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধ নিয়ে অনেক লেখালেখি সমালোচনা ব্যাখা বিশ্লেষন প্রতিবাদ মানববন্ধন হলেও ধর্ষকের সংখ্যা কমেনি। প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে যততত্র ধর্ষণ, এর কোনটি প্রকাশ পায়, কোনটি পায় না। আর মুষ্টিমেয় ধর্ষকের বিচার হলেও অধিক সংখ্যক ধর্ষকের বিচার হয় না।
ধর্ষিতা/ধর্ষিত হওয়া যে কোন নারী বা পুরুষের জন্য মানসিকভাবে চরম আঘাত। চোখের পলকে যে কোন মানসিক আঘাত একজন মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারে। শারীরিক ক্ষত নিরাময়যোগ্য হলেও মানসিক ক্ষত শারীরিক ক্ষতের মতো নিরাময়যোগ্য নয়। তাছাড়া আমাদের সমাজ একজন ধর্ষিত নারীকে কলঙ্কিত আখ্যা দেয়া হয়। ধরে নেওয়া হয়, ধর্ষিতা নারী মানে অপবিত্র। যা যে কোন ধর্ষিত নারী ও তার পরিবারের জন্য আরো বেশি ভয়ঙ্কর ও আতঙ্কের বিষয়। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে মানসিক আঘাতের জন্য সরাসরি কোন শাস্তির বিধিবিধান নেই। শাস্তি যা আছে তা শারীরিক আঘাতের জন্য। প্রচলিত আইনে মানসিক আঘাতের জন্য শাস্তির বিধিবিধান থাকার কথাও না, কেননা মানসিক আঘাতের তীব্রতা নিরূপণ করার মতো ক্ষমতা বিজ্ঞ আদালতের নেই। আর বিষয়টা জটিলও বটে। পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারায় উল্লেখ আছে, ব্যতিক্রম ব্যতিরেক কোন নারীর সাথে ৫ প্রকারে, যৌনসঙ্গম করিলে তা ধর্ষণ বলে পরিগণিত হবে;
প্রথমতঃ কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয়তঃ কোন নারীর সম্মতি ব্যতীত।
তৃতীয়তঃ মৃত্যু বা আঘাতে ভয় দেখিয়ে কোন নারীর সম্মতিতে।
চতুর্থতঃ প্রতরণামূলকভাবে সম্মতিক্রমে।
পঞ্চমতঃ সম্মতিক্রমে বা ব্যতীত ১৪ বছরের কম বয়স্ক কোন নারীর সাথে।
পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারার ব্যাখায় বলা হয়েছে, “ধর্ষণের অপরাধের জন্য প্রয়োজনীয় যৌনসঙ্গমের জন্য যৌনাঙ্গ প্রবিষ্ট করাই যথেষ্ট”। অর্থাৎ ধর্ষণ করার জন্য বীর্যপাতের প্রয়োজনীয়তা (ব্যাখা মোতাবেক) অনাবশ্যক। ধর্ষণ হওয়ার জন্য শুধু পেনিট্রেশনই যথেষ্ট। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ও ৯ক ধারা ব্যতিরেক ধর্ষণের অপরাধের জন্য ৩৭৬ ধারার অধীনে মামলা হলে এবং অপরাধীর অপরাধ আদালতে সন্দেহাতীত প্রামণ হলে, বিজ্ঞ আদালত পেনাল কোডের ৩৭৬ ধারা মোতাবেক অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনধিক ১০ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড তাছাড়া ধর্ষণকারীকে উপর্যুক্ত সাজার পাশাপাশি অর্থদন্ডও দিতে পারেন। পেনাল কোডে ধর্ষণজনিত কারণে কোন নারী বা শিশুর মৃত্যু বিষয়ক কোনো বিধিবিধান নেই। এক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ ও ৯ক ধারা লক্ষ্যনীয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ ধারার (১ – ৫) উপধারায় কোন নারী বা শিশু ধর্ষিত হলে এবং ধর্ষণজনিত কারণে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে সেই সম্পর্কিত শাস্তির বিধিবিধান রয়েছে। ৯ক ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে কোন নারীর সম্ভ্রমহানি করা হলে এবং উক্ত নারী সম্ভ্রমহানি হওয়ার ফলে আত্নহত্যা করলে, সে ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হবে যে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে উক্ত নারীর সম্ভমহানি করেছে, তিনিই তাহাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছে। কোন নারীকে সম্ভ্রমহানী করে আত্নহত্যা করার অপরাধের শাস্তি হল, অনধিক ১০ বছর ও অনূন্য ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও অতিরিক্ত অর্থদন্ড। তাছাড়া উক্ত আইনের ১০ ধারায় যৌন পীড়নের সংজ্ঞা ও শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য তার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য অঙ্গ স্পর্শ করেন বা শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করেন তবে তা যৌন পীড়নের অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে। যার শাস্তি অনধিক ১০ বছর ও অনূন্য ৩ বছর সশ্রম কারদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ড।
মজার ব্যাপার হল, ধর্ষণের মত একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা উঠলে, আমরা অনেকেই বলি, আমাদের দেশের তুলনায় অন্য দেশসমূহে ধর্ষণ বেশি হয়। যেহুতু অন্য দেশের তুলনায় আমরা তুলনামূলকভাবে কম ধর্ষণ করি, সেহুতু আমরা ভালো। পার্টিতে গেলে ধর্ষিত/ধর্ষিতা হওয়টা স্বাভাবিক। কেননা, পার্টির পরিবেশ সবসময়ই ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পরিবেশ বিরাজ করে। পাশ্চাত্যের পোশাক পড়লে ধর্ষণ হতেই পারে। কেননা, পাশ্চাত্যের পোশাকের সাথে ধর্ষণের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার সাথে উপর্যুক্ত কথাগুলোর কোন যৌক্তিকতা নেই। ধর্ষণ ও ধর্ষকের উপযুক্ত বিচার না হলে, যে কোন নারী ও শিশু ধর্ষক কর্তৃক ধর্ষণ হতে পারেন। তবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বাঙালিদের বাঙালি সংস্কৃতির পোশাক পরিচ্ছেদ পরিধান করাটাকে আমি সমর্থন করি। বাঙালি হয়ে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা বাদ দিয়ে লাঘামহীনভাবে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়া ও অন্ধ অণুকরণ করা ব্যক্তিগতভাবে আমারও পছন্দ নয়। পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে (মানুষের) ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ ও অভিরুচির ভিন্নতা থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই বলে, পার্টিতে গেলে ধর্ষণ হতে পারে, পাশ্চাত্যের পোশাক পড়লে ধর্ষণ হওয়াটা স্বাভাবিক। এরকম খোঁড়া যুক্তিগুলোর সাথে সহমত পোষণ করতে পারি না। বোধ করি এমনটি যারা বলেন তারা অধিকাংশই অসুস্থ মস্তিস্কের মানুষ এবং ধর্ষণের সমর্থক। পেনাল কোড ৩৭৫ এর অধীনে ধর্ষণ আর সেচ্ছায় যৌনসঙ্গম সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়। দুঃখের বিষয় হল, আমাদের সমাজে অনেক নারীরাও বেগতিক, তারা অনেক সময় সেচ্ছায় যৌন মিলনে মিলিত হয়ে পরে স্বার্থ হাসিল না হলে পুরুষকে ফাঁসিয়ে দেয় ধর্ষণ মামলায়। ফলে মিথ্যা ধর্ষণ মামলার জের টানতে হয় অনেক নিরপরাধ পুরুষকে। শিকার হতে হয় হয়রানির। আবার অন্যদিকে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে থানায় হাজির হলে, অভিযোগকারীকে হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। ধর্ষিত বা ধর্ষিতার অভিভাবকের পিঠ দেয়ালে না ঠেকলে তারা ন্যায় বিচারের জন্য দারস্থ হতেন না। অনেক প্রভাবশালী ধর্ষক আইনের প্রহেলিকার মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসে, এদিকে অভিযোগকারীগণ দিন শেষে হয়ে পড়েন অভিযুক্ত।