স্টাফ রিপোর্টার
গত বর্ষা মৌসুম থেকে চলতি বর্ষায় নবগঙ্গা নদী গ্রাস করেছে নড়াইলের কালিয়ার শুক্তগ্রামের প্রায় ২শতাধিক বসতবাড়ি ও গাছপালাসহ অন্তত ৮০ একর ফসলি জমি। বছরের পর বছর অব্যাহত নদী ভাঙ্গনে কালিয়ার মানচিত্র থেকে মুছে যেতে চলেছে উপজেলার ওই গ্রামটি। এবার মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় তিন’শ বছরের পুরনো শুক্তগ্রামসহ স্থানীয় বাজার। বর্তমানে অল্প বিস্তর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। যেকোনো মূহুর্তে সেখানককার সরকারি স্থাপনাসহ মসজিদ, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত কয়েক দশকে শুক্তগ্রামের মানুষের ফসলি জমি ‘শুক্তগ্রাম বিল’ গ্রাস করেছে নবগঙ্গা। গত বর্ষায় ভাঙ্গনের তীব্রতা ছিল বেশি। চলতি বর্ষায় পানি কমার সাথেই ভাঙ্গনের তীব্রতার আশঙ্কা করছেন সেখানকার মানুষ।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বাবরাহাচলা ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম শুক্তগ্রাম। উপজেলা সদরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে চলা নবগঙ্গা নদীর ঠিক অপরপাড়ে গ্রামটির অবস্থান। স্থানীয় প্রবীণদের ভাষায়, গ্রামটি অতি প্রাচীন জনপদ। অন্তত তিন’শ বছর আগে গ্রামটির উত্তর পূর্ব প্রান্তে গড়ে উঠেছিল শুক্তগ্রাম বাজার। সেখানে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক মৃৎশিল্পীদের বসবাস আর মৃৎশিল্পের নানা সামগ্রী বেচাকেনার জন্য বাজারটি প্রসিদ্ধ। ঐতিহ্যবাহী সেই বাজারটি এখন যেকোন মূহুর্তে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারের সঙ্গে লাগোয়া নবগঙ্গা নদী। বাজার এলাকায় ভাঙ্গন রোধে নদীর পাড়ে বালুর বস্তা দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে পানির তোড়ে ওই বস্তা নদীতে চলে গেছে। সেখানে আঁছড়ে পড়ছে পানির ঢেউ। বস্তা ফেলার বাইরের অংশে নতুন করে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন।
স্থানীয়রা জানান, গত বর্ষার মাঝদিকে ওইসব বালুর বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করা হয়। তার আগেই বর্ষার শুরুতে শুক্তগ্রাম বাজারের পাশের কুমার পাড়া ও চরপাড়া জনপদ দুটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। গত বছরের ভাঙ্গনে ওই দুটি পাড়ার অন্তত দেড় শত বসতবাড়ি ও ৮০ একর ফসলি জমি নদীতে চলে গেছে। কয়েক দশকে ওই এলাকার ফসলি মাঠ ‘শুক্তগ্রাম বিল’ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নবগঙ্গার ভাঙ্গনে গ্রামটির বহু পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভাঙ্গনের শিকার অসহায় পরিবারগুলো বাজারে, নদীর পাড়ে, রাস্তার পাশে ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
অপরদিকে শুক্তগ্রাম বাজারে রয়েছে অন্তত দেড় শতাধিক দোকানপাট। উপজেলার উত্তর অঞ্চলে এটিই বড় হাট ও বাজার। এখানে রয়েছে ধান-পাটের বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। রয়েছে বাজার কেন্দ্রিক মসজিদ, মন্দির, কমিউনিটি ক্লিনিক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ নানা সামাজিক স্থাপনা। নদীভাঙ্গন রোধ করতে না পারলে বাজারসহ গ্রামটিই গ্রাস করবে রাক্ষুসী নবগঙ্গা। আর সেই সাথে কালিয়া উপজেলার মানচিত্র থেকে মুছে যাবে শুক্তগ্রামের নাম।
ক্ষতিগ্রস্থরা জানান, কুমার পাড়ার অরুণ পাল, বিকাশ পাল, রফি মন্ডল, মিরাজ মোল্লা, কালিদাস পাল, দিলিপ পাল, কুদ্দুস শেখ, দীপক পাল, বেলায়েত শেখ, বাচ্চু শেখ, কামরুল শেখ, কাঞ্চন সরদার, আকতার মন্ডল, ইমরুল মোল্লা, আকবর খা, কার্তিক পাল ও মান্দার খাসহ অন্তত ৬৫টি পরিবারের বসতবাড়ি, চরপাড়ার বেলায়েত মোল্লা, শাহাদত খা, কালু মোল্লা, মিজান খা, মনিরুল মোল্লা, ইয়ার আলী, রব্বান শেখ, আহাদ শেখ, রইস শেখ, আজাদ ফকির, জহির শেখ, রাজু শেখ, আমজেদ সরদার ও মশিয়ার সরদারসহ অন্তত ৮৫টি পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙ্গনের শিকার চরপাড়ার ষাটোর্ধ তোবারেক শেখ বলেছেন, তিনবার নদী ভাঙ্গনে তার বাড়িঘরসহ প্রায় ৩৫ একর ফসলি জমির সবই নদীতে গেছে। সর্বশেষ ২ একর ৫৬ শতক জমিতে ছিল বসতবাড়ি। ওই বসতবাড়ির ফলফলালি বিক্রি করেই সংসার চলছিল, নদীতে ভাংতে ভাংতে এখন মাত্র ১৫ শতক জমি আছে। ওই জমিতে এক কোণে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছে তার পরিবার। যেকোনো মূহুর্তে তা নদীতে চলে যেতে পারে।‘এখন আমরা নিঃস্ব।’ চরপাড়ার আহাদ শেখ (৪০) বলেছেন, ‘আমাদের ৭৫ শতাংশের ওপর বসতবাড়ি ছিল। বাড়ির ফলফলালি বিক্রি করে চলত সংসার তা নদীতে ভেঙ্গে যাওয়ায় এখন আমরা পথের ফকির।’ কুমারপাড়ার ষাটোর্দ্ধ কুদ্দুস শেখ বলেছেন, ‘তিন একর ফসলি জমি ছিল, এ ছাড়া বসতভিটার ফলফলালি বিক্রি করে চলত সংসার। সব নদীতে গেছে। এখন নদীপাড়ে ঝুপড়িঘর তুলে আছি। জন বিক্রি করে কোনোমতে চলছে তাদের সংসার।’
কালিয়ার ইউএনও মো. নাজমুল হুদা বলেছেন, ইতোমধ্যে নড়াইলের জেলা প্রশাসকসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ভাঙ্গন এলাকা পদির্শন করেছেন। ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা গ্রহন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
নড়াইল পানিউন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহ নেওয়াজ তালুকদার বলেছেন, সম্প্রতি তিনিসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা শুক্তগ্রাম ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বাজারের আশপাশে সামান্য ভাঙ্গন আছে। এলাকাটিতে নজর রাখা হচ্ছে। ঝুকিপূর্ন অবস্থা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।