ঘাট ম্যানেজার ও দুই সহকারী দ্রুত ফেরি ছেড়ে দিলে তিতাসকে বাঁচানো সম্ভব হতো!

0
45

ডেস্ক/এসএস

ফেরি বিলম্বের ঘটনায় নড়াইলের ছেলে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর অভিযোগ তদন্ত করে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। গত ২৫ জুলাই রাতে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এক নম্বর ফেরিঘাটে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষকে বহণকারী অ্যাম্বুলেন্স আটকা পরে। সময় মতো হাসপাতালে না নেয়ায় অ্যাম্ব্যুলেন্সেই মৃত্যু হয় তিতাসের। অ্যাম্বুলেন্স আটকা পড়ার কারণ হিসেবে জানা যায় যে সরকারের এ টু আই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলের গাড়ি পারাপার করার জন্য ফেরিঘাটের সকল ফেরি প্রায় ২ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়।

একজন ভিআইপির অপেক্ষায় প্রায় দুই ঘণ্টা ফেরি এবং ফেরির জন্য অপেক্ষা করা অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখার কারণে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনায় নিন্দার ঝড় বয়ে যেতে শুরু করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে তিতাসের পরিবারকে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৩১ জুলাই এই ঘটনার তদন্ত শুরু করার নির্দেশ দেন।

হাইকোর্টের এই নির্দেশে গত ৩০ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. রেজাউল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তিন সপ্তাহের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও তারা সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি জমা দিতে না পারায় গত ২৮ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ আদালত থেকে আরো কিছুদিন সময় নেয়। এরপর বৃহস্পতিবার দুপুরে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে কমিটি তদন্ত শেষে হাইকোর্টে দাখিল করার জন্য ৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে।

এই প্রতিবেদন অনুসারে, তদন্ত কমিটি যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলের কোনো দোষ খুঁজে পায়নি। কিন্তু ওই যুগ্মসচিবের জন্য ২ ঘণ্টা ফেরি দাঁড় করিয়ে রাখার সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনটিতে মোট তিনজনকে দায়ী করা হয়েছে। অভিযুক্ত তিনজন হলেন- ঘাট ম্যানেজার মো. সালাম হোসেন, প্রান্তিক সহকারী মো. খোকন মিয়া এবং উচ্চমান সহকারী ও গ্রুপ প্রধান ফিরোজ আলম। তাদের বিরুদ্ধে মূলত কর্মে অবহেলা, ঘাট ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও বিআইডব্লিউ পরিপত্র লঙ্ঘন করে বিলম্বে ফেরি ছাড়ার জন্য অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযুক্ত এই তিনজনের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, “ঘাটে লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীবাহী অ্যাম্ব্যুলেন্স ফেরি পারের জন্য অপেক্ষা করছে এটা জানা থাকা সত্বেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অ্যাম্ব্যুলেন্স পারাপারে সহায়তা না করে ‘কুমিল্লা ফেরি’ নির্ধারিত সময়ের আনুমানিক ২ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। ফলে অনাকাঙ্খিত ঘটনা সৃষ্টিতে তারা (তিনজন) দায়ভার এড়াতে পারে না। ফেরি ছাড়তে যদি ২ ঘণ্টা দেরি না করতো তাহলে হয়তো তিতাসকে বাঁচানো সম্ভব হতো।”

অন্যদিকে যে যুগ্ম সচিবের জন্য ফেরি ছাড়তে দেরি করা হয়েছে তার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যুগ্মসচিব সরকারি সফরে থাকায় যে রুটে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল, সে রুটে ধর্মঘট চলায় বিকল্প রুট হিসেবে মাদারিপুরের কাঠালবাড়ি ফেরি ঘাটে যান। এজন্য তিনি আগেই মাদারিপুরের জেলা প্রশাসকের সহায়তা চান। জেলা প্রশাসক ঘাটের ম্যানেজারকে বিষয়টি জানান। এরপর ম্যানেজারের সঙ্গে যুগ্মসচিবের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়।” প্রতিবেদনটিতে আরোও বলা হয়, “মুমুর্ষ রোগী অপেক্ষা করছে-এই তথ্য ঘাট ম্যানেজার যুগ্মসচিব বা জেলা প্রশাসককে জানাননি। এ কারণে তিনি (যুগ্মসচিব) জানতেন না যে, ঘাটে মুমূর্ষু রোগী অপেক্ষা করছে। তাই তাকে (যুগ্মসচিব) অভিযুক্ত করার মতো যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।’

প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ জাতীয় অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে যে ৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এই ৭ দফা সুপারিশে বলা হয়েছে, ১. ঘাট থেকে ফেরি ছাড়া ও পৌঁছানোর সময় স্থায়ী লগবুক/রেজিষ্ট্রারে লিখে মাস্টারকে স্বাক্ষর করতে হবে। ২. ফেরি ঘাটে ভিড়িয়ে বা ফেরির র‌্যাম্প উঠিয়ে কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।

৩. নীতিমালা অনুযায়ী ভিআইপি সুবিধা চেয়ে কেউ ফেরি পারাপার হতে চাইলে তাকে অবশ্যই তার সরকারি ভ্রমণ বিবরণী আগে হতে ফেরি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হবে। তবে জরুরি প্রয়োজনে আগে যোগাযোগ সাপেক্ষে ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ম শিথিল করা যেতে পারে।

৪. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহি অ্যাম্বুলেন্স/গাড়ি পারাপারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৫. প্রত্যেক ঘাটে ও ফেরিতে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে গাড়ি ও ফেরি পারাপারের বিষয় সমূহ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

৬. ফেরিঘাট ও ফেরিতে কর্মরত সকলের নাম ট্যাগসহ নির্দিষ্ট পোষাক (ইউনিফর্ম) পরিধান করতে হবে। এবং ৭. ফেরিঘাট ও ফেরিতে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল নম্বরসমূহ প্রদর্শন করতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এ বি এম আব্দুল্লাহ আল জানিয়েছেন যে আগামী ১৩ অক্টোবর হাইকোর্ট নিয়মিত খোলার পর প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।