নিউজ ডেস্ক
গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) সড়ক দুর্ঘটনায় সঙ্গীত পরিচালক পারভেজ রবের মৃত্যু হয়ছে। উত্তরার ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের সামনে ভিক্টর পরিবহনের বাস চাপায় দিয়ে প্রাণ গিয়েছে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক আপেল মাহমুদের চাচাতো ভাই পারভেজের। পারভেজের পরিবারে শোকের মাতম শেষ হয়নি তখনো। কুলখানির আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত সবাই। তাই আত্মীয়স্বজনদের কুলখানিতে আসার দাওয়াত দিতে বের হয় ছেলে ইয়াসির আলভী রব।
গত শনিবার বাল্যবন্ধু মেহেদী হাসান ছোটনকে (২০) সাথে নিয়ে রাতে কুলখানির খাবার ও জিনিসপত্র কিনতে টঙ্গীর উদ্দেশ্যে রওনা হন ইয়াসির। ঠিক তখনই ঐ ভিক্টর পরিবহনের অন্য একটি বাসের ধাক্কা ও চাপায় গুরুতর আহত হন ছেলে ইয়াসির আর নিহত হয়েছেন ইয়াসিরের প্রিয় বন্ধু মেহেদী।
গুরুতর আহত ইয়াসিরকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে শ্যামলীর ট্র’মা সেন্টারে ভর্তি করা হয়। আর পরেরদিন তুরাগের ধউর এলাকায় স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ছোটনকে। একই পরিবহনের বাসের চাপায় এমন মৃত্যু আর দুর্ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না ইয়াসির ও ছোটনের পরিবার। মনের মধ্যে চলছে শোকের মাতম। তাদের মতানুসারে, ভিক্টর পরিবহনের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে যে কেউ দুর্ভাগ্যের শিকার হতে পারেন। ঘাতক বাসচালক ও মালিকের শাস্তি চান তারা।
রোববার ট্র’মা সেন্টারে নিহত কণ্ঠশিল্পী পারভেজ রবের স্ত্রী রুমা সুলতানার সাথে সাংবাদিকদের কথা হলে তিনি জানান যে শনিবার বিকেলে ধউর এলাকার স্থানীয় আবুল মাতুব্বরের বাড়িতে একটি সমঝোতা বৈঠক হয়েছিল যেখানে তার বোন কামরুন্নাহার ও বোন জামাই বাবুল উপস্থিত ছিল। অন্য দিকে ভিক্টর পরিবহনের মালিকের কিছু লোকজন এসেছি। বৈঠকে তার বোন দুর্ঘটনার জন্য বাস কর্তৃপক্ষের কাছে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। এক পর্যায়ে তা ২০ লাখ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু বাসের মালিক পক্ষ জানায়, তারা এত টাকা দিতে পারবে না তবে তারা বাস মালিকের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবেন। ফলে ঐ সমঝোতা বৈঠক ব্যর্থ হয়। এজন্য শনিবার রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন তিনি। এই মামলায় বাসচালক, হেলপারসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। মামলা করার সময় খবর পান ছেলে তার বন্ধুকে নিয়ে বাবার কুলখানির খাবার কিনতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
রুমা আরও জানান যে বাসের মালিক পক্ষ তাদের বারবার হু’মকি দিয়ে বলছিলো যে দেখি সাংবাদিকদের দিয়ে আপনারা কত লেখাতে পারেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “স্বামীকে হারালাম। সন্তানদের নিয়ে এখন কোথায় দাঁড়াব? ধউর এলাকায় বড় হয়েছে তার ছেলে। হয়তো ভিক্টর পরিবহনের চালক ও হেলপার আমার ছেলেকে আগে থেকে চিনত। তাই বাসের ওঠার চেষ্টা করলেও দরজা বন্ধ করে এঁকেবেঁকে বাস চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। তবে বাসে ওঠার সময় আমার ছেলে জানত না ওই বাসটি ভিক্টর পরিবহনের।”
এরপর রুমা জানান যে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তার ছেলে বা ছেলের বন্ধুরা রাস্তায় কোনো গাড়ি ভাংচুর করেনি। গাড়ি চলাচলে বাধা দেয়নি। অনেকে বলাবলি করছে যে, গাড়ি আটকাতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় ছেলে ও তার বন্ধু দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে- এটা ঠিক নয়। গাড়ি আটকাতে কেন দু’জন রাতে সেখানে যাবে।
রুমা সুলতানা বলেন মাত্র চার দিন আগে তার স্বামী পারভেজ রবকে বাসচাপা দিয়ে ‘হ’ত্যা’ করা হয়েছে। একই কোম্পানির বাসে আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে ছোট ছেলে ইয়াসির। কোমরের হাড় ভেঙে গেছে। ছেলে হাসপাতালে থাকায় তার স্বামীর কুলখানির অনুষ্ঠান ও বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে, সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন স্বামী পারভেজ। তিনি নেই। ছেলের চিকিৎসা খরচ কীভাবে জোগাবেন তা নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কিভাবে তিনি ছেলে মেয়ে নিয়ে বাঁচবেন এবং তাদের লেখাপড়ার খরচ জোগাবেন এই নিয়ে তিনি অত্যন্ত চিন্তার মধ্যে পরেছেন।
দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে চিকিৎসাধীন ইয়াসির জানান, তিনি শনিবার সন্ধ্যায় বাবার কুলখানি অনুষ্ঠানের কেনাকাটা করতে যাচ্ছিলেন টঙ্গী বাজারে। সঙ্গে ছিল তার ছোটবেলার বন্ধু মেহেদী হাসান। ধউর এলাকার বাসা থেকে বেরিয়ে বাস না পেয়ে আব্দুল্লাহপুরগামী একটি ছোট্ট ট্রাকে ওঠেন তারা। বেড়িবাঁধ স্লুইসগেটে পৌঁছালে যানজটে ট্রাক থেমে যায়। এ সময় তারা নেমে পড়েন। যানজটে আটকে থাকা ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের বাসে ওঠার চেষ্টা করেন। বাসে ওঠার আগেই হেলপার ভেতর থেকে দরজা আটকে দেন। পরে তিনি দরজার পাশের খোলা জানালা দিয়ে গেট খুলতে অনুরোধ করেন হেলপারকে। সে সময় চালক ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বাস বেপরোয়াভাবে টান দেন। জানালা ধরে তিনি বুক থেকে মাথার অংশ বাসের ভেতরে ঢুকিয়ে চিৎকার করতে থাকেন- ‘তিনি বাসে ঝুলছেন’। বাস থামাতে চালককে অনুরোধ করেন। কিন্তু তার কথা কর্ণপাত করেননি চালক। এঁকেবেঁকে বাস টানতে থাকেন।
তিনি বলেন, “বাসের সামনের দিকে একটি মিনিবাস ছিল। ওই বাসের সঙ্গে আমার ও মেহেদীর চাপা লাগে। মনে হলো আমার কোমর থেকে হাড় ভেঙে গেল। ১৫-২০ গজ এ অবস্থায় সামনের দিকে যাওয়ার পর চলন্ত অবস্থায় আমি হাত ছেড়ে দিলে রাস্তায় পড়ে যাই। আর উঠে দাঁড়াতে পারিনি।”
আহত অবস্থায় তাদেরকে প্রথমে উত্তরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেহেদীর মৃত্যু হয়। রাতেই ইয়াসিরকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রোববার দুপুরে সেখান থেকে ট্র’মা সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। তার কোমরের ডান পাশের হাড় ‘ফ্যাকচার’ হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
রবিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ম’র্গে মেহেদীর লাশের ময়’নাতদন্ত করা হয়। পরে লা’শ নেওয়া হয় ধউর এলাকার বাসায় এবং বিকেলে ধউরের এলাকার কবরস্থানে তার লাশ দা’ফন করা হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে মেহেদীর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। তিনি এইচএসসি পাস করার পর আর পড়ালেখা করেননি। চাকরি খুঁজছিলেন। মেহেদীর বাবা ইউসুফ মিয়া জানান যে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মেহেদী ছোট। চাকরি পাওয়ার পর অনার্স ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা আর পূরণ হলো না।
মেহেদী হাসানের এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য ভিক্টর পরিবহনের নামে বাদী হয়ে মামলা করে তার মামাতো ভাই ফিরোজ আলম। তিনি বলেন, “কেউ কোথাও যেন নিরাপদ নয়। বিচার চাওয়া ছাড়া আর কী বলব। চালকরা যেন নেশার ঘোরে গাড়ি চালায়। কাউকে পরোয়া করে না ওরা।”
একই পরিবহনের বাস দ্বারা সংঘটিত দুইটি দুর্ঘটনায় দুইজনের প্রাণ যাওয়ার ঘটনায় করা দুটি পৃথক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হলেন উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই মো. সাদেক। তিনি জানান, “পথচারীদের সহায়তায় শনিবারের দুর্ঘটনার পরপরই ভিক্টর পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৮৬৭০) চালক রফিকুল ইসলামকে আটক করা হয়েছে। চালকের সহকারী সোহেল ও কন্ডাক্টর মোমেন পালিয়েছে। দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩০৪(খ) ও ৩৩৮ (ক) ধারায় মামলা হয়েছে। মামলায় সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তবে পারভেজ রবের দুর্ঘটনায় দায়ী বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-০৩৫৫) চালক মো. শাহ আলমকে গ্রেফতার করা যায়নি।”
তিনি আরো বলেন, “শনিবার দুর্ঘটনায় দায়ী চালকের কাছে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে। তা প্রকৃত কি-না জানতে বিআরটিএ’তে পাঠানো হবে। ওই বাসের মালিক জনৈক দুলাল বলে জানিয়েছেন চালক। তারও আসল পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।”
উল্লেখ্য, যে গত বৃহস্পতিবার বনানীতে ফুটপাতে বাস উঠে গিয়ে চাপা দেয় ফারহা নাজ নামে এক কর্মজীবী নারীকে যিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আবার গত ২৭ আগস্ট বাংলামটরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণা রায় চৌধুরী নামে বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপকের পায়ের ওপর তুলে দেওয়া হয় বাস। এতে কাটা পড়ে তার এক পা। এভাবে বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করার ঘটনা যেন একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্রঃ সমকাল