মীর আব্দুল গণি
৪। শিক্ষাদানের প্রয়োজন ও প্রয়োজনীয় বিষয় কী? ব্যক্তির জীবনযাত্রার (বিচরণ) ক্ষেত্র লক্ষ করলে দেখা যায়- এমন অনেক বিষয় আছে যা ব্যক্তির জীবনযাত্রার মানোন্নায়ন ও অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তার জানা বা শেখা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তি নিজ থেকে অনুরূপ বিষয়সমূহ শেখার কৌশল ও গুরুত্ব অনুধাবনে অক্ষম। যেহেতু ব্যক্তি নিজে শেখার কৌশল ও গুরুত্ব অনুধাবনে অক্ষম সেহেতু তার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য অবশ্যই তাকে ঐ সকল বিষয়ে শিক্ষাদানের প্রয়োজন দেখা দেয়। এবং উক্ত ক্ষেত্রে (ব্যক্তির জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য) অবশ্যই বিবেচ্য হতে হবে ব্যক্তির স্বতন্ত্র ও সমষ্টিগত জীবনযাত্রায় একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহে বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান।
যে বিষয়সমূহের শিক্ষাকে পরবর্তিতে ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়রূপে বিস্তারিত আলোচনা করব। উপরিউক্ত আলোচনায় শিক্ষাদানের প্রয়োজন কেন এবং শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয় ও বিবেচ্য বিষয় কী হবে তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
৫. শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য কী ?
শিক্ষাদানের ফলে সত্তার বোধগত উপলব্ধির উন্মেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে প্রতিয়মান হয় যে, শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো সত্তার স্বকীয় বোধ-চেতনার কাঙ্ক্ষিত পবিবর্তন সাধন করা। যেমন- খ- ১ + ২ = ২, ২ – ১ = ১ বলতে ও লিখতে শেখানো হয়েছে। উক্ত ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়- শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো- সত্তাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ‘আচরণ সক্ষম’ করে তোলার লক্ষ্যে তার স্বকীয় বোধ-চেতনার স্থলে কাঙ্ক্ষিত বোধ-চেতনার উন্মেষ সাধন করা। যেমন- ক- ১ + ১ = ?, ২ – ১ = ? … (অনাকাঙ্ক্ষিত) স্বকীয় আচরণ সক্ষমতার স্থলে খ- ১ + ২ = ২, ২ – ১ = ১, কাঙ্ক্ষিত আচরণ সক্ষমতার উন্মেষ সাধণ করা। উপরিউক্ত আলোচনায় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য কি তুলে ধরা হয়েছে। এ পর্যায়ে আমরা শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ছকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য সহজে তুলে ধরতে পারি। যেমন-
সত্তার ’ক’ ও ’খ’ উভয় আচরণ উপলব্ধির উৎস বা উপলব্ধির স্থলকে সত্তার “বোধ-চেতনা” রূপে আখ্যায়িত করলে প্রতীয়মান হয় শিক্ষাদানে সত্তার আচরণ উপলব্ধির উৎস তার বোধ-চেতনায় ’খ’ আচরণ-শীলতার উন্মেষ সাধন করা হয়েছে। যেমন-
স্বকীয় বোধ-চেতনা ’ক’
উন্মেষিত বোধ-চেতনা ’খ’
সত্তার বোধ-চেতনার ’খ’ আচরণশীলতায় প্রতিয়মান হয়। শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো- সত্তার বোধ-চেতনায় কাঙ্ক্ষিত ’খ’ আচরণের উন্মেষ সাধন করা।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য বুঝতে হলে অবশ্যই শিক্ষাদানের ফলে সত্তার উন্মেষিত আচরণ সক্ষমতার বৈশিষ্ট্য বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সত্তার আচরণ সক্ষমতার বৈশিষ্ট্য : যেমন- সত্তার বোধ-চেতনায় উন্মেষিত ’খ’ আচরণশীলতায় প্রতিয়মান হয়- সত্তার ’খ’ আচরণ সক্ষমতা তার ’’ক’’ আচরণসক্ষমতার (স্থলে) বোধ-চেতনায় সুপ্ত বা ঘুমন্ত ছিল। শিক্ষাদানে তার সুপ্ত বা ঘুমন্ত ’খ’ আচরণ সক্ষমতার জাগরণ ঘটানো হয়েছে। সত্তার ’খ’ আচরণ বৈশিষ্ট্যের কারণে আমরা উল্লেখ করতে পারি- সত্তার ‘উন্মেষিত বোধ-চেতনা’ উৎসারিত ’খ’ আচরণ সক্ষমতা হলো- সত্তার সুপ্ত বা ঘুমন্ত আচরণ-সক্ষমতার জাগরণ বা বিকাশ।’
যেমন- সত্তার খ- ১ + ১ = ২, ২ – ১ = ১ আচরণ সক্ষমতা হলো- বোধ-চেতনার উন্মেষ সাধিত বা বিকাশ সাধিত আচরণ সক্ষমতা যা সত্তার ’’ক’’ আচরণ সক্ষমতার (স্থলে) বোধ-চেতনায় সুপ্ত বা ঘুমন্ত ছিল। সত্তার ’ক’ আচরণের স্থলে জাগ্রত করে তোলা ’খ’ আচরণ সক্ষমতায় প্রতিয়মান হয় যে, শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো- সত্তার বোধ-চেতনায় তার সুপ্ত বা ঘুমন্ত আচরণ সক্ষমতার কাঙ্ক্ষিত ও সুশৃঙ্খল জাগরণ ঘটানো বা বিকাশ সাধন করা।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা উল্লেখ করতে পারি- শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো- সত্তার স্বকীয় বোধ-চেতনার স্থলে কাঙ্ক্ষিত বোধ-চেতনার উন্মেষ সাধন করে সত্তাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আচরণ সক্ষম করে তোলা।
প্রশ্ন হলো বোধ-চেতনাই যে সত্তার সুপ্ত বা ঘুমন্ত আচরণ সক্ষমতার উৎস তার প্রমাণ কী? বোধ-চেতনাই যে সত্তার সুপ্ত বা ঘুমন্ত আচরণ সক্ষমতা এবং আচরণ উপলব্ধির উৎস এ পর্যায়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
প্রমাণ : প্রমাণের জন্য আমরা একই শ্রেণির প্রা’ণী সত্তার বিপরীত আচরণশীলতার বৈশিষ্ট্যগত দিক নিয়ে আলোচনা করব। যেমন- ব’ন্য ও গৃহপালিত ঘোড়ার আচরণশীলতা। মনে করি ব’ন্য ঘোড়ার আচরণ : ক স্বকীয় গৃহপালিত ঘোড়ার আচরণ : খ শিক্ষা দ্বারা উন্মেষ সাধিত গৃহপালিত অর্থাৎ প’শুকে শিক্ষা দিয়ে গৃহে অবস্থান ও বিভিন্ন কর্মসম্পাদনে সক্ষম করে তোলা। ব’ন্য ঘোড়ার স্বকীয় আচরণ ‘ক’ তা তার স্বকীয় বোধ-চেতনা উৎসারিত। (প্রত্যাশিত বা সুশৃঙ্খল নয়) ব’ন্য ঘোড়ার ‘ক’ আচরণের উৎসকে বোধ-চেতনা রূপে আখ্যায়িত করলে দেখা যায়- শিক্ষা দ্বারা উন্মেষ সাধিত গৃহপালিত ঘোড়ার ‘খ’ আচরণের উৎসও হলো তার বোধ-চেতনা। কারণ শিক্ষা দ্বারা বিভিন্ন কর্মসম্পাদন সক্ষমতা হলো তার উন্মেষিত বোধ-চেতনা উৎসারিত ‘খ’ আচরণ সক্ষমতা।
যেমন- গৃহে অবস্থান, ভার বহন, সার্কাসে ক্রীড়া প্রদর্শন, দৌড় প্রতিযোগিতা বা যেকোনো কর্মসম্পাদন আচরণ সক্ষমতা। ঘোড়ার উক্ত রূপ ‘খ’ কর্মসম্পাদন আচরণ সক্ষমতার উন্মেষে প্রতিয়মান হয় উক্ত কর্মসমূহ সম্পাদনের ‘খ’ আচরণ সক্ষমতা সত্তার বোধ-চেতনায় সুপ্ত বা ঘুমন্ত ছিল। শিক্ষাদানে উক্ত সক্ষমতাকে জাগ্রত করে তোলা হয়েছে। অর্থাৎ সত্তার ‘ক’ আচরণের উৎসকে বোধ-চেতনা রূপে আখ্যায়িত করলে উক্ত স্থলে ‘খ’ আচরণ সক্ষমতার উন্মেষ বা বিকাশই প্রমাণ করে- বোধ-চেতনায় সত্তার আচরণ সক্ষমতা সুপ্ত বা ঘুমন্ত। অর্থাৎ- বোধ-চেতনা হলো সত্তার আচরণ সক্ষমতার উৎস।বিশেষ উল্লেখ্য উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সত্তার দুটি আচরণ বৈশিষ্ট্য প্রয়োজনে পরবর্তী আলোচনায় অতি সংক্ষেপে আমরা নিম্নরূপে উল্লেখ করব।
যেমন- ক. আচরণ বলতে সত্তার স্বকীয় আচরণ বুঝাব। খ. আচরণ বলতে শিক্ষা দ্বারা সত্তার উন্মেষ সাধিত আচরণ বা সত্তার সুপ্ত বা ঘুমন্ত আচরণ সক্ষমতার সুশৃঙ্খল জাগরণ বুঝাব। উপরিউক্ত আলোচনায় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য এবং সত্তার বোধ-চেতনাই যে আচরণ সক্ষমতার উৎস আমরা তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। (চলবে)
গঠনমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা
মীর আব্দুল গণি
জার্মানি প্রবাসী