এ্যাড. আবদুস ছালাম খান
৮ ডিসেম্বর লোহাগড়া মু’ক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে পাকবাহি’নীর দো’সর পুলিশ ও রা’জাকারদের দখ’লে থাকা লোহাগড়া থানা ও থানা সংলগ্ন লক্ষ্মীপাশা এলাকা দখ’লমু’ক্ত করে নেয় বীর মু’ক্তিযো’দ্ধারা। মাত্র ঘন্টা চারেকের সন্মু’খযু’দ্ধে লোহাগড়া থানা এলাকা মু’ক্তিযো’দ্ধাদের দখ’লে আসলেও সে যু’দ্ধে দুইজন বীর মু’ক্তিযো’দ্ধা রা’জাকা’রদের গু’লিতে শা’হাদ’ত বর’ণ করেন।
তাদের একজন উপজেলার কোলা গ্রামের হাবিবুর রহমান এবং অপরজন যশোর সদর উপজেলার জঙ্গল-বা’ধাল গ্রামের মোস্তফা কামাল তাজ। এই বীর মু’ক্তিযো’দ্ধা ভারতের টা’লিখো’লা ক্যা’ম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহনকালীন সময় ইতনা অঞ্চলের মু’ক্তিযো’দ্ধাদের সাথে সংযুক্ত হয়ে মু’ক্তিযু’দ্ধে অংশগ্র’হণের জন্য এ অঞ্চলে চলে আসেন। লোহাগড়া থানাকে দখ’লমু’ক্ত করার স’ম্মুখ যু’দ্ধে শ’হীদ হলে তাকে ইতনা হাইস্কুল মাঠে জানা’জা শেষে সেখানেই সমা’হি’ত করা হয়।
ইতনা হাই স্কুলের প্রবে’শ মু’খে শ’হীদ মিনারের পাশে এই বীর মু’ক্তিযো’দ্ধা আজো চি’র নি’দ্রায় শা’য়িত আছেন। আর কোলা গ্রামের বীর মু’ক্তিযো’দ্ধা শহী’দ হাবিবুর রহমানকে লোহাগড়া থা’না ক’ম্পাউন্ডের মধ্যেই স’মা’হিত করা হয়। লোহাগড়া থানার নতুন ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে এই বীর মু’ক্তিযো’দ্ধার ক’বর রয়েছে।
লোহাগড়া থানা পা’কদোস’রদের হা’ত থেকে দ’খ’লমুক্ত করার সে যু’দ্ধের কিছু অংশ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। ফলে থানা দখ’লমু’ক্ত করার সে যু’দ্ধ আমার স্মৃ’তিতে আজও জ্ব’লজ্ব’ল করে। কারণ মু’ক্তিযু’দ্ধের বছরে আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। অর্থাৎ কোন কিছু দেখে মনে রাখার মত পূর্ণ ব’য়স। ফলে থানা দখ’লমুক্ত করার যু’দ্ধ ছাড়াও মু’ক্তিযু’দ্ধকালীন সময়ে লোহাগড়া থানা এলাকায় পা’কবাহি’নী ও তাদের দো’সর রা’জা’কার বা পুলিশদের অনেক ক’র্ম-অ’পক’র্ম স্বচক্ষে দেখেছি এবং মনে রেখেছি। লোহাগড়া থানার মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত কুন্দশী গ্রামে আমার বাড়ি হওয়ায় আমার এ সুযোগ হয়েছে।
তৎকালে থানায় একজন সাব ই’ন্সপে’ক্টর র্যাংকের পুলিশ কর্ম’কর্তা ওসি হিসাবে থানা প্রধান থাকলেও লোহাগড়া থানায় ছিল ব্যতিক্রম। এখানে একজন ওসি থাকলেও খালেক পুলিশ নামে একজন ক’ন্সটেবলই ছিল কার্যতঃ থানা প্রধান। তার এতটাই দাপ’ট ছিল সবাই তাকে মনে করতো দারো’গা। কেউ কেউ ওসিও মনে করতো। আমরা কুন্দশী গ্রামের লোকেরা কখনো কখনো পাক আ’র্মিদের চাইতে ‘খালেক পুলিশ আ’তঙ্কে’ থাকতাম বেশি। তা ছাড়া আমাদের গ্রামের একটি পরিবার খালেক পুলিশের ‘খুব ঘনি’ষ্ট’ ছিল। ওই পরিবারের ঠান্ডু নামে এক ব্যক্তিকে অবশ্য ওই অভিযো’গে ন’কশা’লরা গ’লা কে’টে খু’ন করে ফেলে।ফলে থানা দখ’লের দিনে খালেক পুলিশের পরিণতি দেখার কৌ’তুহল ছিল বেশি।
এদিকে ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মু’ক্তিযো’দ্ধাও মি’ত্র বাহি’নীর যৌথ আ’ক্র’মনের ফলে সারা দেশে পাকবা’হিনী কো’নঠা’সা হয়ে পড়ার সংবাদে রা’জাকা’ররা যেমন ভী’ত-স’ন্ত্র’স্থ হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি মু’ক্তিযো’দ্ধারা অধিক উ’ৎসা’হে সংগ’ঠিত হতে থাকে। তাছাড়া ৬ ডিসেম্বর একই দিনে প্রথমে ভুটান এবং পরে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় মু’ক্তিযো’দ্ধাদের ম’নো’বল বে’ড়ে যায়। ওইদিনেই মু”ক্তিবাহি’নীর যৌথ আ’ক্র’মনে পাক আ’র্মিরা যশোর সে’নানিবা’স ছেড়ে গি’লাতলা সে’নানিবা’সে পা’লিয়ে যায়।
ফলে লোহাগড়া অঞ্চলের মুক্তিযো’দ্ধারা সংগঠিত হয়ে ৮ ডিসেম্বরকে থানা দখলের চু’ড়ান্ত দিন হিসাবে বেছে নেয়। মু’ক্তিযো’দ্ধাদের থানা অ’পারে’শনের এই গো’পন সিদ্ধা’ন্ত আমাদের পরিবার পূর্বরাতেই জেনে যায়। উল্লেখ্য আমার বড়ভাই আতিয়ার রহমান খান (টুলু) টা’লিখো’লা ক্যা’ম্পে মু’ক্তিযু’দ্ধের ট্রে’নিং নিয়ে দেশে ফিরে ইতনার মু’ক্তিযো’দ্ধাদের সাথে সংযু’ক্ত থাকে।
থানা অ’পারে’শনের পূর্ব রা’ত্রিতে সে হঠাৎ কয়েক ডজন ড্রা’ইসে’ল ব্যা’টা’রী হাতে একজন মু’ক্তিযো’দ্ধার সাথে বাড়ি আসে। দ্রু’ত বাড়ির সবার সাথে দে’খা করে যাবার সময় গো’পনে জা’নিয়ে যায়-ভোর রাতেই থানা আ’ক্রমন করা হবে। গো’লাগু’লি শুরু হলে তোমরা নিরাপ’দ অবস্থা’নে আ’শ্রয় নিও। তবে তিনি এও জানিয়ে যায় যে মু’ক্তিযো’দ্ধাদের প্র’স্তুতি এতটাই যে রা’জাকা’ররা বেশিক্ষ’ন টি’কতে পারবে না। তাই তোমাদের বাড়ি ছেড়ে পা’লিয়ে যাবার দরকার নেই। এদিকে আমার চাচা রফিউদ্দিন খান তখন আ’বসরপ্রা’প্ত পুলিশ সদস্য। গো’লাগু’লির সময় পরিবারের নিরাপ’ত্তার জন্য তিনি উঠানের পাশে পূর্বেই একটা ব’ড় বাং’কার কে’টে রেখেছিলেন। ভো’ররাতে গো’লাগু’লি শুরু হলে আমাদের বড়ির সবাই ওই বাং’কা’রে আশ্র’য় নেয়।
কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম এদিকে তেমন গু’লি আসছে না। অ’র্থাৎ পুলিশ রা’জাকা’রদের গু’লি করা ক’মে গেছে। রা’স্তায় দুই-একজন লোক দেখা যা’চ্ছে। আমিও এক পা দুই পা করে থানার দিকে এগিয়ে নবগ’ঙ্গা নদীর পাড়ে গিয়ে একটা ব’ড় শিমুল গাছের ‘বাড়ন্ত পটের’ আড়া’লে গিয়ে আশ্র’য় নি’লাম। ত’তক্ষণে ভোরের সূর্য উ’ঠে গেছে।
দেখি নদীর ওপারের পা’ড় ধরে কয়েকজন মুক্তিযো’দ্ধা নী’চু হয়ে থানার দিকে দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও তখন টুটু রায় নামক আমার এক প্রতিবেশি কি’শোরকে সাথে নিয়ে ন’দী পার হয়ে ওপারে যাবার জন্য জে’লে পা’ড়ার দিকে এগোতে থাকি। কিন্তু কোথাও কোন নৌ’কা না পেয়ে লোহাগড়া বাজারের কাছে চলে গেলাম। বাজার সংলগ্ন কাড়াল পাড়ার সোজা নদীর চরে জ’রাজী’র্ণ একখানি বড় নৌকা পড়ে থাকতে দেখে আমার মত কয়েকজনকে নিয়ে নৌকাটি পানিতে ভা’সি’য়ে পা’রের উদ্দেশে উঠি। কিন্তু নৌকাটি ভা’ঙ্গাচো’রা হওয়ায় দেখি পানি উঠছে। হা’তের কাছে কোন বৈ’ঠা না পেয়ে আমরা বাঁ’শের চ’টা ও হা’ত দিয়ে বে’য়ে যে’তে যেতে নৌকাটি পানিতে ভ’রে যায়। আমরা লা’ফ দিয়ে পা’ড়ের কা’দা-পা’নিতে পড়ে দ্রুত থা’নার দিকে এগিয়ে যেতে দে’খি বিজ’য়ী মুক্তিযো’দ্ধারা ত’তক্ষ’ণেও থানার ভে’তরে লু’কিয়ে থা’কা রা’জা’কার’দের ধৃ’ত কর’তে পারে নাই। থানার সামনের (ত্রিমোহনায়) রাস্তায় দুই সহো’দর মু’ক্তিযো’দ্ধা একজন রা’জাকা’রের হাত পি’ঠমো’ড়া করে বেঁ’ধে নিয়ে এসে গু’লি করতে উ’দ্দত। তারা চি’ৎকা’র বলছে-তুই আমার ভা’ইকে মে’রেছিস। তোর জন্যই আমরা মু’ক্তিযু’দ্ধে গেছি। ওই রা’জাকা’র তার হাত খুলে গু’লি করতে অনুরো’ধ করলেও মুহুর্তে দুই সহো’দরের নতুন এসএলআরের ব্রা’শ ফা’য়ারে তার দে’হ *ক্ষ’ত-*বিক্ষ’ত হয়ে মা’থার ঘি’লু বের হয়ে যায়। ভাই *হ’ত্যার প্র’তিশো’ধের এ নৃ’শং’স দৃ’শ্য দেখে আমার স’ঙ্গী কিশো’রটি ভ’য় পেয়ে কেঁ’দে ফেলে। আমরা স্থান ত্যা’গ করে খুঁ’জতে থাকলাম সেই কুখ্যা’ত খালেক পুলিশকে।
এ সময় দে’খি চান মিয়া নামে চরকরফার একজন বীর মু’ক্তিযো’দ্ধা দুই কাঁ’ধে দুইটা রা’ইফে’ল নিয়ে থানা থেকে বেরি’য়ে আসছে। তার হা’তে একটা মু’ড়ির টি’ন।ওর কাছে খালেক পুলিশের কথা জা’নতে চাইলে সে জা’নায় তার কাছের অতিরি’ক্তটা খালেক পুলিশের রা’ইফে’ল। তবে টিনের ভিতরে কি ছিল তা জানতে চাইনি। সে জানায় মু’ক্তিযো’দ্ধারা ওকে ল’ক্ষ্মীপাশা স্কুলের দিকে ধরে নিয়ে গেছে। একথা বলে চান মিয়া দ্রু’ত বাড়ির উদ্দেশে খে’য়াঘাটের দিকে চলে এলো।
আমরা দু‘জনে হাই স্কুলের দিকে যেতে হাসপা’তালের ভেতরে ঢু’কে দেখি রা’জাকার কমান্ডা’র ফজলে করিম র’ক্তা’ক্ত অব’স্থায় হা’সপাতা’লের বা’রান্দা’য় পড়ে কা’তরা’চ্ছে। তার পা’ছার মাং’স খানিকটা গু’লি’তে উ’ড়ে গেছে। র’ক্তে বারা’ন্দা ভে’সে গেছে। সে আমাদের কাছে সাহায্য চাইলে আমরা দ্রুত স্থান ত্যা’গ করি। আমরা রাস্তায় গিয়ে দেখি একদল লোক খালেক পুলিশের দুই পায়ে জিআই তার দিয়ে বেঁ’ধে টে’নে লক্ষ্মীপাশা খে’য়া ঘা’টের দিকে নিয়ে আসছে। আমরা ওদের পিছু অনুসরণ করলাম। ওই লোকগুলি খে’য়া ঘা’টের উপর থাকা পাহা’ড়ি নিম গাছের সাথে খালেক পুলিশের *পা উপরের দিকে দিয়ে ঝু’লি’য়ে দিল। ওর দেহে গু’লি ও বে’য়নে’টের জ’খ’ম দিয়ে তখনও র’ক্ত ঝ’রছিল এবং সে কোন রকমে জী’বিত ছিল।
এ দৃশ্য দেখে ক্ষ’মতার দা’পট কার কতক্ষণ তা ভাবতে ভাবতে বা’ড়ি আসার সি’দ্ধা’ন্ত নিলাম। ততক্ষ’ণে খেয়াঘা’টে নৌকা পা’রপা’র শুরু হয়ে গেছে। পারের উদ্দেশে ঘা’টের দিকে নামতেই দেখি মুক্তিযো’দ্ধারা একদল রা’জা’কারের হা’তে দ’ড়ি বেঁ’ধে (গ’রু বাঁ’ধার মত) নিয়ে আসছে। রা’জাকারদের কেউ কেউ আমার পরিচিত হলেও কাউকে কিছু না বলে দ্রুত পা’র হয়ে চলে এলাম।