আবদুস ছালাম খান
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে অবস্থিত প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক ভিটা এখন নামেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সম্পত্তি। অথচ অযত্ন ,অবহেলা আর অনাদরে এই বরেণ্য ঔপন্যাসিকের পৈত্রিক বাড়িটি ভেঙ্গে-চুরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে।সরকারী বা বেসরকারী কোন উদ্যোগে এখন আর তাঁর জন্ম ও মৃ’ত্যুবার্ষিকী পালিত হয় না। বর্তমান প্রজন্ম জানেই না গুণী এই ঔপন্যাসিকের কথা।
‘আনন্দ অন্নদা কুটির’নামের তার এই পৈত্রিক বাড়িটি এখন চরম অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সম্প্রতি প্রখ্যাত এই বাঙ্গালী ঔপন্যাসিকের পৈত্রিক বাড়িটি দেখার জন্য সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় দ্বিতল এই ভবনটির পলেস্তরার কিছু অংশ উঠিয়ে ফেলা হয়েছে এবং বাকি অংশ খসে পড়ছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোন বালাই নাই। অধিকাংশ রুমের জানালা দরজার কপাট নাই। বাড়িটির এক অংশে মিনতি মন্ডল নামে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখা গেল । তিনি পৈত্রিক সূত্রে ওই বাড়িতে আশ্রিতা। তার কাছে জানা গেল কয়েক বছর পূর্বে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ বাড়িটি অধিগ্রহন করে সংস্কারের উদ্যেগ গ্রহন করে। এসময় তারা বরাদ্দকৃত অর্থ কোন ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ না করে নিজেরাই করতে থাকে। কিন্তু কাজের গুনগত মান অতি নিম্নমানের ছাড়াও প্রাক্কলিত কাজ অসমাপ্ত রেখেই তারা চলে যায়। ওই সময়ে একখানি স্মৃতি ফলক স্থাপন করলেও তা কোন সালে তা উল্লেখ নাই। বাড়িতে কোন কেয়ার টেকার নেই। ফলে কেউ কোন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন না। পরিচ্ছন্নতার অভাবে সেখানে কোন দর্শনার্থীর আগমন ঘটে না।
নিহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯১১ সালের ৬ জুন পিতা সত্যরঞ্জন গুপ্তের কর্মস্থল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান কলকাতায় হলেও তাঁর পৈত্রিক নিবাস নড়াইলের লোহাগড়ার উপজেলার ইত্না গ্রামে। ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্ত চাকরিজীবী পিতার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকালে ১৯৩০ সালে ভারতের কোন্ন নগর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই তিনি আই. এস. সি পাস করে ও কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর ডাক্তার হিসেবে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। চাকরি জীবনের বাধ্যবাধকতা তাঁর কাছে বিরক্তিকর মনে হওয়ায় তিনি এ চাকরি ত্যাগ করে কলকাতায় ব্যক্তিগতভাবে আবার ডাক্তারী শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কলকাতায় বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন।
নীহাররঞ্জন গুপ্ত শৈশব থেকে সাহিত্যে হাতে খড়ি হয়ে ছিল। ষোল বছর বয়সেই তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাস ‘রাজকুমারী’ ছাপা হয়। তাঁর লিখিত উপন্যাসের সংখ্যা দুইশতেরও অধিক। তাঁর মধ্যে ‘মঙ্গলসূত্র’, ‘উর্বশী সন্ধ্যা’, ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘অমৃত পাত্রখানি’, ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘অশান্ত ঘূর্ণি’, ‘মধুমতি থেকে ভাগীরতী’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘ঝড়’,‘অপারেশন’, ‘ধূসর গোধূলী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘কালোভ্রমর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘কালোহাত’, ‘ঘুম নেই’, ‘পদাবলী কীর্তন’, ‘লালু ভুলু’, ‘কলঙ্ককথা’, ‘হাসপাতাল’, ‘কাজললতা ও কিশোর সাহিত্য সমগ্র উল্যেখযোগ্য। নীহার রঞ্জনের চল্লিশের অধিক উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘লালুভুলু’, ‘হাসপাতাল’, ‘মেঘ কালো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘নূপুর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘বাদশা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মায়ামৃগ’, ‘কাজললতা’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি।
তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘লালুভুলু’ পাঁচটি ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি বাংলাদেশেও চিত্রায়িত হয় এবং দর্শককুলের প্রশংসা অর্জন করে। নীহার রঞ্জন গুপ্তের অনেক উপন্যাস থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস উল্কা দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটারের দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে।
চিকিৎসক হিসেবে অতি কর্মচঞ্চল জীবনযাপনের মধ্যেও নীহার রঞ্জন রেখে গেছেন অসংখ্য সাহিত্যধর্মী সৃষ্টি যা আপন সত্তায় ভাস্বর হয়ে থাকবে। নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯৮৬ সালের ২০ জানুয়ারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এই গুণী মানুষটির পৈত্রিক শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু পূর্ণ সংষ্কার না করলে পুরাতন ভবনটি নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ইতনা গ্রামের বিশিষ্ট সাংষ্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিক্ষক নারায়ন বিশ্বাস বলেন , বাড়িটি নামেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সম্পত্তি। সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করলেও উল্লেখযোগ্য কোন সংষ্কার করে নাই। বরং অধিগ্রহন করায় বেসরকারিভাবে আমাদের কিছু করা সুযোগ নাই। এই গুণী ঔপন্যাসিক আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে সমুজ্জল থেকেও আমরা তাকে ভুলতে বসেছি। আমাদের প্রজন্ম জানেই না নীহার রঞ্জন গুপ্ত কে ছিলেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়িটি পূর্ণ সংষ্কার করা হলে পর্যটকদের কাছে এটি একটি দর্শণীয় স্থান হতে পারে।